যে বইগুলো আমাদের মনে দাগ কাটে, ভাবনার দোয়ার খুলে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়, জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়; যে বইগুলো আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখে সেগুলোকে আমরা জীবন পাল্টে দেয়া বই বা সেরা বই বলতে পারি। জীবন পাল্টে দেয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়া এরকম বইয়ের তালিকা করতে বলা হলে এই বছরে যে বইগুলোর নাম নেবো আগামী একছর বা দশবছর পর দেখা যাবে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে, অনেক যোগ-বিয়োগ হবে। একই কথা সাজে পেছনের বছরগুলোর বেলাতেও। স্কুলজীবনে যে ধরণের বই ভালো লেগেছে, দাগ কেটেছে; কলেজে দেখা গেছে অন্য ধরণের বই ভালো লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনগুলোতে যে বইগুলো ভালো লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকিয়ে হয়তো সেগুলো আর ভালো লাগছেনা বা ভালো লাগার তালিকায় নতুন কিছু যোগ হয়েছে।
একজন সচল ও সক্রিয় পাঠকের পছন্দের তালিকা সবসময় বিকাশমান। এটাও সত্য প্রত্যেক পাঠকের জীবনে এমন কিছু বই থাকে যেগুলো প্রিয়, প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকায় সারাজীবন থেকে যায়।
আমার তালিকা করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মহাগ্রন্থগুলো রাখিনি। তবে ভূমিকাতে তাদের নাম নিয়ে রাখলাম। পবিত্র কুরআন, পবিত্র বাইবেল, পবিত্র গীতা আমার পড়া তিনটি অসাধারণ গ্রন্থ। প্রত্যেকটিই বহুবার পড়া। শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোও ঠিক এমন প্রভাবশালী হবে বলেই মনে করি। প্রত্যেকটি ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলো একে একে পড়ে শেষ করার আশা রাখি।
চলেন, পড়ার মতো, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়ার মতো, জীবন পাল্টে দেয়ার মতো দশটি বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই।
১. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ-সেনেকা
রোমান দার্শনিক লুকিউস আন্নাইউস সেনেকার লেখা ‘জীবন এতো ছোট কেন’ আমার পড়া সবচেয়ে সেরা বইয়ের একটি। ল্যাটিনে ‘দ্য ব্রেভিতাতে ভিতায়ে’ কে ইংরেজিতে ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ করা হয়েছে। বাংলা করার সময় প্রথমদিকে আমি এটাকে ভাবার্থে ‘জীবন ছোট নয়’ হিসেবে চালিয়েছে। পরবর্তীতে ল্যাটিনে দক্ষতা রয়েছে এমন এক পণ্ডিতবরের সহায়তায় ‘জীবন এতো ছোট কেন’ ব্যবহার করা শুরু করেছি। নাম যেভাবেই দেই না কেন দুটোতেই বইটির ভাব সুষ্পষ্ট হয়।
বইটির প্রথমদিকেই জীবন এতো ছোট কেন সেটি নিয়ে অনেকের প্রশ্নের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে। বইটি শেষ করলে আমরা উত্তর পাবো জীবন ছোট নয়। তবে এর সাথে কিছু ‘যদি, কিন্তু’ রয়েছে। সেগুলো অনুসন্ধানের জন্যই বইটি পড়তে হবে। শুধু পড়লেই হবেনা। সেনেকা যে পথ বাতলে দিয়েছেন সেই মতে কাজ না করলে ফল লাভ হবে না। এই স্বল্পমেয়াদী জীবনকে যদি ফলবান, মূল্যবান করতে চাই তাহলে সময়কে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে সে বিষয়ে কার্যকরী সদুপদেশ নিয়ে হাজির সেনেকা।
![]()
বইটি আকারে ছোট কিন্তু গুরুত্বে অনেক ভারী, তাই এক পাঠে চলবে না। সবসময় কাছে রাখার মতো একটি বই। বইটিতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এসেছে। যেমন অনেকেই এই প্রশ্ন করে মানুষ কেন এতো অল্প দিন বাঁচে কেন, মানুষের জীবন এতো ছোট কেন?
অনেকের মাথায় এই প্রশ্ন জাগে-কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, অনুজীব, ভাইরাস আছে যা মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় বাঁচে কিন্তু মানুষ কেন এতো অল্প সময় বাঁচে? মানুষ যেখানে কতো বড় বড় কাজ করতে পারে সেখানে কিছু প্রাণীকে মানুষের চেয়ে পাঁচগুণ, দশগুণ বেশি সময় দিয়ে রাখা হয়েছে যাদের ভোজন-আহার ও বাচ্চা পয়দা ছাড়া আপাত আর কোন কাজ নেই।
মানুষকে কম সময় দেয়া হয়েছে এটি স্বীকার করতে সেনেকা নারাজ। তিনি মনে করেন, আমাদেরকে অল্প সময় দেওয়া হয়নি বরং আমরা আমাদের সময়ের বড় অংশটাই অপচয় করি। আমাদের সময়ের পুরোটা যদি ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে সে সময়ের মধ্যেই অনেক বড় বড় কাজ করাই সম্ভব। কিন্তু এটা যদি হেলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়, শুধু ভোগে বিলিয়ে দেওয়া হয়, কোন মহান উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো না হয় তাহলে দেখা যাবে সময়টা কখন যে হাওয়ায় উড়ে গেছে, একেবারে টের পাওয়ার আগেই।
বেশিরভাগ মানুষই কিভাবে অন্যের জন্য বাঁচে, অন্যের জীবন যাপন করে এবং সবচেয়ে কম কাছের থেকে যায় নিজের কাছে, এর উপলব্ধি হবে বইটি পড়ে। মানুষ কেমন অদ্ভূতরে আচরণ করে, এমনকি নিজের সঙ্গেও! তারা তাদের মালিকানায় থাকা জায়গা-জমির এক ফুট ও যদি অন্য কেউ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে কেমনে ক্ষেপে যায়, তেড়ে আসে, এমনকি জান কুরবান করে ফেলে বা অন্যেরটা নিয়ে ফেলে! অথচ কোন মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যদি থাকে সেটা হলো সময়। আমরা সেই মূল্যবান সম্পদ সময়টিতে কিভাবে বিভিন্ন মানুষকে ভাগ বসিয়ে দিতে দেই? এবং জায়গা-জমি, অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে বড় কিপটা হলেও সময় সম্পদ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বদান্য। যাকে তাকে মালিকানা দিয়ে দেই এই মহামূল্যবান সময় বা সময়ের বড় অংশটুকুর। সেনেকার মতে এটা এমন বড় ডাকাতি যেটা মালিক টেরই পায় না।
আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার। সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়।
আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার। সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়। তাই আমার মতে বই মানুষের জন্য সেরা সফটওয়ার। আর একেকটা সেরা বই পড়া হচ্ছে একেকটা সফটওয়ার ইন্সটল করা; তার মানে জগতকে একেকবার একেকটি দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা অর্জন করা।
সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ আমার কাছে তেমন একটি বই। যখন মনে হয় অহেতুক সময় অপচয় করছি, যখন মনে হয় আমি আমার নিজের কাছে কমিটমেন্টের সাথে প্রতারণা করছি, আমার মনের গহীন কোণে হতাশার চাষবাস করছি তখনই এমন কিছু সফটওয়ারের সাহায্য নেই। এগুলো ইনস্টল করার মাধ্যমে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি।
আমাদের সময়ের পুরোটা যদি ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে সে সময়ের মধ্যেই অনেক বড় বড় কাজ করা সম্ভব।
আমি বইটি পড়ে নিজে উপকৃত হয়েছি। সময় ও নিজের জীবনের মূল্য নিয়ে সচেতন হয়েছি। নিজের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার উপর আত্মবিশ্বাস মজবুত করেছি। সেনেকার মূল বয়ানটার সঙ্গে একেবারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে স্বীকার করি-জীবন ছোট নয়, যদি সেটাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়।
একই সঙ্গে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনের কথা এ জায়গায় স্মর্তব্য: ‘আপনি কী কী করতে অক্ষম সেগুলো নয় বরং আপনি যা যা করতে সক্ষম তা-ই যদি ঠিকঠাকভাবে করেন তাহলে আপনি নিজেই নিজেকে বিস্মিত করবেন।’
আপনি কী কী করতে অক্ষম সেগুলো নয় বরং আপনি যা যা করতে সক্ষম তা-ই যদি ঠিকঠাকভাবে করেন তাহলে আপনি নিজেই নিজেকে বিস্মিত করবেন।
২. দ্য স্টোরি অব ফিলসফি-উইল ডুরান্ট
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো মনে হবে যেন এক সমৃদ্ধ খনি। সেখানে মেলে নানা মণি- মুক্তা, মূল্যবান সম্পদ। সেসব সম্পদ আবার কিপটে লোকের মতো সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখতে হয় না। এ সম্পদ এমন যা বিলিয়ে দিলে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
উইল ডুরান্ট তার ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’তে এমন মহামূল্যবান সম্পদের সমারোহ ঘটিয়েছেন। পাশ্চাত্য দর্শনের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস এই ৭০০ পৃষ্ঠার বইয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন।
এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যেকার বিভিন্ন দার্শনিকদের জীবন ও প্রধান দার্শনিক কর্মকাণ্ডগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যেকোন স্তরের পাঠক দর্শনের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে, আড়াই হাজার বছরের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে পরিচিত হতে পরম বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে পারে ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’কে।
![]()
উইল ডুরান্টের বড় যে শক্তির জায়গা সেটি হলো তার সমৃদ্ধ কিন্তু সহজবোধ্য ভাষা। উইল ডুরান্ট স্বয়ং নিজে ইতিহাসের দর্শনের বড়ো পুরোহিতদের একজন। এজন্য দর্শনের অগ্রযাত্রার কোন পর্বটাতে আলো ফেলতে হবে, দর্শনের কোন রথি মহারথিকে জনসমক্ষে পেশ করতে হবে তা তিনি বেশ ভালো করেই জানেন। এজন্য বইটির আঙ্গিক, বুনন ও বিস্তারে পরিপক্বতা ও নিপুণতার ছাপ স্পষ্ট করে প্রতিভাত হয়।
তার লেখা প্রতিটি ইতিহাস গ্রন্থই একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতার সন্ধান দেয়!
দর্শনের বিস্তৃত দুনিয়ায় প্রবেশ ও দখল করতে আগ্রহীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ও কার্যকর একটি দরজা হতে পারে উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’।
৩. দ্য সেয়িংস অব কনফুসিয়াস
কনফুসিয়াস ছিলেন একই সাথে একজন রাজনীতিবিদ, কবি, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং সাধু। একই সঙ্গে অনেক কিছুর মিশেল।
শিক্ষার এই নিত্য নিম্নমুখী যাত্রার প্রাক্কালে দাড়িয়ে অতীতে ফিরে দেখতে চাচ্ছিলাম এমন শিক্ষক কি ছিলেন যাদেরকে ছাত্ররা মন থেকে সম্মান করতো? যাদের জ্ঞান সমকাল থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী বিভিন্ন যুগে মানুষকে দিশা দিতো? এই অনুসন্ধান চালিয়ে দেখলাম মানবজাতির ইতিহাসে সেরা কয়েকজন শিক্ষকের তালিকাতে বেশ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত কনফুসিয়াসের নাম।
চীনে কয়েক হাজার বছর ধরে অনেক সম্মানিত এবং আদৃত মহামানব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছেন তিনি, বর্তমানে যার নাম বিশ্বের আনাচে কানাচেও উচ্চারিত হচ্ছে। চীনের তিন মহারথী লাও জু, সান জু আর কনফুসিয়াসের শিক্ষা সবসময় আলো জাগানিয়া।
![]()
The Sayings of Confucius, Introduction and Notes by Lionel Giles
কনফুসিয়াসের শিক্ষার একটা বড় দিক হচ্ছে এটা একেবারে পরিবার থেকে শুরু করার কথা বলেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসংহত ও সুন্দর সম্পর্ক থাকলে সবচেয়ে বড় পরিবার যে রাষ্ট্র সেখানেও সুন্দর সম্পর্ক নিশ্চিত হয়। কারণ রাষ্ট্রও তো একটি বৃহৎ পরিবার। ছোট্ট পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আমাদের বৃহৎ পরিবারে খুবই কাজের হিসেবে ঠেকে।
কনফুসিয়াসের মতে-‘আমরা তিনটি উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি: প্রথমত, গভীর চিন্তা বা অনুধ্যানের মাধ্যমে যেটা মহত্তম উপায়; দ্বিতীয় যে উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি সেটা হলো অনুকরণ, যেটা সহজতম; আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেটা সবচেয়ে তেতোময়।’ (p39-40, The Sayings of Confucius, Introduction and Notes by Lionel Giles, E. P. BUTTON AND COMPANY, NEW YORK, 1910)
আমরা তিনটি উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি: প্রথমত, গভীর চিন্তা বা অনুধ্যানের মাধ্যমে যেটা মহত্তম উপায়; দ্বিতীয় যে উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি সেটা হলো অনুকরণ, যেটা সহজতম; আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেটা সবচেয়ে তেতোময়।
শিশু প্রথম বড় শিক্ষাটা পায় তার পরিবার থেকে। সেখানে বাবা-মার আচার আচরণ শিশুর জীবনে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখে। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর মন-মগজ-মনন ও চরিত্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকদেরকে অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা। এজন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে খুব সতর্কভাবে নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। কনফুসিয়াস বলেন ‘পচা কাঠে নকশাঁ করা যায় না’। এজন্য নষ্ট শিক্ষক, নষ্ট শিক্ষা কাঠামো থেকে বড় মানুষ, ভালো মানুষ বের হওয়া অনেক কঠিন।
নিজ জন্মভূমি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ফিরে খুঁজছিলেন সেই দার্শনিক সম্রাটকে। এ যেন প্লাতোর ‘ফিলসফার কিং’ খোঁজার প্রচেষ্টার সাথে তুল্য, বা চাণক্যের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে অখন্ড ভারতের অধিপতি খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্খা।
‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং সকল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনো। তাহলে জনগণ সন্তুষ্ট হবে। আর অপরাধীদেরকে লালন করো এবং ভালো মানুষদেরকে বিতাড়িত করো তাহলে অসন্তুষ্ট হবে’।
এক শাসক কনফুসিয়াসের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন: কি কাজ করলে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখা যায়? কনফুসিয়াসের উত্তর ছিল:
‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং সকল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনো। তাহলে জনগণ সন্তুষ্ট হবে। আর অপরাধীদেরকে লালন করো এবং ভালো মানুষদেরকে বিতাড়িত করো তাহলে অসন্তুষ্ট হবে’।
একটা দেশের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার সাথে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সে দেশের কৃষ্টি কালচার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ভালো সরকার ব্যবস্থার জন্য এ সবকটি উপাদান একসাথে কাজ করতে হবে। জু কুং নামে এক শিষ্য কনফুসিয়াসকে জিজ্ঞেস করেছিল- ‘ভালো সরকার কেমন?’ এর উত্তরে কনফুসিয়াস বলেন: ‘জনগণের পর্যাপ্ত অন্ন সংস্থান করলে, দেশের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য মজুদ রাখলে এবং দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলে তাকে ভালো সরকার বলা যাবে। এখন এ তিনটি জিনিসের মধ্যে যদি একটিকে ত্যাগ করতে হয় তাহলে প্রথমে সৈন্য-সামন্তকে ত্যাগ করতে হবে। তারপর বাকি দুটোর মধ্যেও যদি একটিকে ত্যাগ করতে বলা হয় তাহলে সেটা হবে অন্ন। কারণ কোন না কোন সময় মানুষকে তো মরতে হবেই। কিন্তু জনগণের আস্থা ছাড়া কোন সরকারই টিকে থাকতে পারে না।’
কি অসাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক শিক্ষা কনফুসিয়াসের। তার কথাগুলো আমাদের জন্য কতই না প্রাসঙ্গিক।
৪. অনুস্মৃতি-পাবলো নেরুদা
পাবলো নেরুদার জীবন পাঠ করে মনে হলো যেন এক মহাসমুদ্রের মত জীবনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতরূপে অসংখ্য নদীর সম্মীলন যেন তার বিশাল সমুদ্রস্বরূপ জীবন। কত তীড়ে তরী ভিড়িয়েছেন মহান এ কবি। তার পুরো জীবনটাই যেন ক্লাসিকাল সংগীতের মত। বিভিন্ন সুর, তাল লয়ের সম্মীলন। একজন কবি বড় হয়ে উঠেন তার বড় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। কবিদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হয় ঈগলের মত। অনেক দূর থেকে অতি সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জিনিস দেখার ক্ষমতা আছে ঈগলের। কবিদেরকে মানবের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার এমনতর প্রস্তুতি থাকতে হয়।
কবিরা কেমন এ নিয়ে শার্ল বোদলেয়ার যাকে আর্তোর র্যাবোঁ ‘কবি সম্রাট’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন একটি আকর্ষণীয় কথা বলেছেন। কথাটা সরলভাবে বললে এমন দাড়ায় কবিদের ডানা এত বিস্তৃত যে তারা মাটিতে পা রাখতে পারেন না। অসীম আকাশেই কবিদের বসবাস!
কবিদেরকে বুঝাতে গ্রীক শব্দ Vates (ভাতেস)ব্যবহৃত হয়। খুব মজার ব্যাপার হলো প্রফেট এবং পোয়েট এ দুটো বুঝাতেই গ্রীকে এই একটি শব্দই ব্যবহৃত হতো। মানে পরিষ্কার কবি ও নবীকে তারা একই গোত্রের মনে করতো।
![]()
পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা পড়ে মনে হচ্ছিল তিনি যেন শার্ল বোদলেয়ারের সেই ঈগল পাখির মতো বিশাল ডানা মেলে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়েছেন আর জীবন থেকে দুহাত শুধু নয় চারহাত ভরে অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। এই বিশাল ভবঘুরে সারা বিশ্বকে নিজের ঘর আর আসমানকে সামিয়ানা করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। একজীবনে এত দেশ, এত মানুষের সঙ্গ, এত মানুষের সাথে বন্ধুতা, শত্রুতা, এত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা পাওয়া একজনের পক্ষে কিভাবে সম্ভব?
আমার পড়াশুনার অনেকগুলো কারণের মধ্যে যে কারণগুলোকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রাখি সেটা হলো:
প্রথমত, আমি নিজকে গড়ার জন্য পড়ি।
দ্বিতীয়ত, চলমান সংকটে পথ বা জীবনের রথ চালানোর জন্য অনুপ্রেরণা খুঁজি
জানার জন্য, বুঝার জন্য, আশ্রয়ের জন্য, বিনোদনের জন্য, সময়ের প্রয়োজনে পড়া তো আছেই। তবে আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে আমি সাধারণত প্রথমে এই উত্তরটিই দেই যে আমি পড়ি ‘টু শেইপ মাইসেল্ফ আপ’। দ্বিতীয়ত খুব আনন্দের মুহূর্তে বা কষ্টের মুহূর্তেও বই আমার খুব কাছের বন্ধু।
মোবাইলে কথা বলার জন্য যেভাবে রিচার্জ করতে হয় তেমনি জীবনকে সামনে নিয়ে যেতে হলে ভালো অনুপ্রেরণা লাগে। এ অনুপ্রেরণা পেতে হলে আমাদেরকে কিছু মহান জীবনের কাছে যেতে হয়, তাদের ছায়ায় কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বই হচ্ছে তাদের কাছে পৌছার সবচেয়ে ভালো দরজা।
মোবাইলে কথা বলার জন্য যেভাবে রিচার্জ করতে হয় তেমনি জীবনকে সামনে নিয়ে যেতে হলে ভালো অনুপ্রেরণা লাগে। এ অনুপ্রেরণা পেতে হলে আমাদেরকে কিছু মহান জীবনের কাছে যেতে হয়, তাদের ছায়ায় কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বই হচ্ছে তাদের কাছে পৌছার সবচেয়ে ভালো দরজা। আর সেটা যদি হয় ওই মহান লেখক বা কবির নিজের লেখা তাহলে তো কথাই নেই। পাবলো নেরুদার ‘অনুস্মৃতি’ পড়ে রিচার্জ হয়েছি এটা বলতে পারি নির্দ্বিধায়।
বইটি মূলত স্পেনিশ ভাষায় লিখিত হয়েছে। চিলিতে জন্ম নেয়া নেরুদার এ আত্মজৈবনিক লেখাটির মূল নাম স্পেনিশে ‘Confiesco que he vivido: Memories’। এর বাংলা ‘মর্মানুবাদ’ করেছেন ভবানীপ্রসাদ দত্ত। ‘অনুস্মৃতি’ নামে বইটি কলকাতায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশে একুশে পাবলিকেশন্স এটা পুন:প্রকাশ করে ২০০৪ সালে।
নেরুদা ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলিতে জন্মগ্রহণ করলেও সারা বিশ্বে রয়েছে তার অধিকার এবং তার উপরেও রয়েছে বিশ্ববাসীর অধিকার। এজন্য আমরা দেখতে পাই তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় কয়েকটি দেশ তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। তবে এর বিপরীত অভিজ্ঞতাটাই বেশি। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতাসীনদের দাবড়ানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। তার মাথা ও জীবনের মূল্য ধরে রেখেছিল চিলির স্বৈরশাসকেরা। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য স্বৈরশাসকেরাও তাকে আশ্রয় দেয়নি। এজন্য কখনো প্যারিসে, কখনো ইতালি বা স্পেনে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বড় একটা সময়। সারা বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের ছিলেন তিনি আত্মার আত্মীয়। এজন্য খুব সহজেই তাদের সাথে মিশে যেতে পারতেন এবং তাদের একজন হয়ে যেতেন। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী প্যারিস রিভিয়্যুতে এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে নেরুদা বলেছিলেন,
“আমি একজন চিলিয়ান। দশকের পর দশক আমি দেখেছি কিভাবে এ দেশের মানুষগুলো দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। আমিও দেশের অংশ হিসেবে তাদের কষ্ট-সুখের ভাগিদার হয়েছি। আমি তাদের কাছে অতিথি নই। আমি এই জনগণ থেকেই উঠে এসেছি এবং আমি তাদেরই অংশ। আমি একটি শ্রমজীবি পরিবার থেকে উঠে এসেছি…আমি ক্ষমতাসীনদের মতন নই। আমার পেশা এবং দায়িত্ব হচ্ছে চিলিয়ান জনগণকে সেবা করা। এবং আমি আমার কাজ এবং কবিতার মাধ্যমে সেটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি তাদের গান গেয়ে, তাদের পক্ষ নিয়েই বেঁচেছি।”
সত্যিই তিনি ছিলেন শ্রমজীবি, কৃষক, মুটের অতি আপনজন। তাদের জীবন সংগ্রামের কথা তার লেখাতে উঠে এসেছে নিঁখুতভাবে। সাধারণ মানুষও তাকে ভালোবেসেছে কাছের বন্ধু হিসেবে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে। তবে তিনি শাসকগোষ্ঠির কাছে বিশেষ করে স্বৈরশাসকদের কাছে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তার কবিতা, তার শব্দঝঙ্কার অনেক স্বৈরশাসকের তখত কাপিয়ে দিতো। এজন্য তাকে আটক বা হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো স্বৈরশাসকদের সেনারা। এজন্য বিভিন্ন ছদ্মনাম, ছদ্মবেশ এবং সাধারণ মানুষদের ভীড়ে হারিয়ে গিয়েই নিজেকে রক্ষা করতেন নেরুদা।
প্রথম জীবনে অবশ্য চিলির বাণিজ্যদূত হিসেবে কাজ করেছেন সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও মোহিকার মত দেশগুলোতে। ১৯২৮ এর দিকে এই ভারতবর্ষেও বেশ কিছুদিন ছিলেন এবং গান্ধী, নেহরুসহ অনেকের সাথেই পরিচিত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাতেও অবস্থান করেছিলেন নেরুদা। এ সব মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি নেরুদা আমাদেরও আত্মীয় এবং তার গড়ে উঠার পেছনে এই ভারতীয় উপমহাদেশও ভূমিকা রেখেছে।
৫. চাণক্যনীতি-চাণক্য
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই যে এক শক্তিশালী দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন সেটা অনেকেই ভুলে যাই বা অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যাই। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচিত হলে আমরা যে সমৃদ্ধ হবো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনা থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত মানুষের সম্ভাব্য যতগুলো দিক আছে তার প্রতিটির উপরই আলো ফেলেছেন এবং প্রাজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন। চাণক্যের সমরবিদ্যা চৈনিক সমরবিদ সান জুর তুলনায় কোন অংশে কম নয়। সান জুর মতো চাণক্যের বেলাতেও বলা যায় ‘তুমি যদি চাণক্যের পরামর্শ শুনো কোন ক্ষেত্রে পরাজিত হবে না আর যদি তার পরামর্শের অন্যথা করো তাহলে তোমার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
চাণক্যের অনেক কথায় পাঠক অবাক হবেন, বেশ বড়সড়ো ধাক্কা খাবেন। প্রথম ধাক্কাটি হবে তিনি এত আগে মানুষের চরিত্র নিয়ে কত অগ্রসর স্টাডি করেছিলেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় তিনি খুবই নির্মম বা ঘৃণ্য কথা বলেছেন। চাণক্যকে পড়ার ক্ষেত্রে অন্ধ হওয়া যাবে না। তার গ্রহণযোগ্য মতগুলো নিয়ে ভাবনার জায়গা রয়েছে আবার বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য মতকে নির্মম হাতে বাতিল করতে হবে।
নারী প্রসঙ্গে চাণক্যের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই নিম্নতর। যদিও ব্যক্তিজীবনে মাকে অনেক সম্মান করতেন এবং তার গড়ে উঠার পেছনে মায়ের অবদান বেশ বলে জানা যায় তারপরও নারীদের নিয়ে তিনি সমকালের সাধারণ সিদ্ধান্ত থেকে বেশিদূর আগাতে পারেননি। মৌমাছি যেমন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে নেয় তেমনি চাণক্যের কাছ থেকে আমরা শুধু মধুগুলোই নেই, গরলগুলো না হয় বাদ গেলো।
চাণক্যে যতসব মধু আছে সেগুলো জীবন সাজাতে অনেক উপকারে লাগবে যেমনটা উপকারে এসেছে গত দুই হাজার বছরে।
‘বোকা শিষ্যদের জ্ঞান বিলিয়ে পণ্ডিত লোকও দুঃখে পতিত হতে পারে, যেমনটা মূর্খরা রমণীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলে, কমবখত লোকের পাশে বেশিদিন থাকলে।’
উপরের কথাটির অর্থ হতে পারে বোকা শিষ্যরা গুরুর জ্ঞান ঠিকমতো নিতে পারে না, যতটুকু নেয় সেটা ভুল করে উপস্থাপন করতে পারে। এ কারণে বোকা শিষ্য গুরুর জন্য হতাশা নিয়ে আসতে পারে। আর ঘরে শান্তি নষ্ট করার জন্য এক মূর্খরা রমণীই যথেষ্ঠ। আর কমবখত লোকের আশেপাশে বেশি সময় অবস্থান করলে তার প্রভাব পড়বে সাধু লোকের উপরও। কারণ মানুষ তার পরিবেশ ও আশেপাশের লোকদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়। এজন্য শিষ্য, স্ত্রী বা সঙ্গী বাছাইয়ে খুব সতর্ক হওয়ারই পরামর্শ চাণক্যের।
চাণক্যের আরেকটি নির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বলেন: ‘ওই দেশে অবস্থান করো না যেখানে তোমার সম্মান নেই, তোমার জীবিকা অর্জনের সুযোগ নেই, তোমার বন্ধু নেই বা তুমি জ্ঞান অর্জন করতে পারো না।’
চাণক্যনীতি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক প্রভাবশালী টেক্সট। সহজ ভাষায় অনেক শক্তিশালী কথা বলে দেওয়ার জন্য দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে টেনেছে চাণক্যের বাণী।
একজন যোগ্য পণ্ডিতের দিনগুলো কেমন হবে তার কথা বলতে গিয়ে কি সুন্দর কথাটিই না বলেছেন চাণক্য। তিনি বলছেন একটি দিনও যেন শেখা বহির্ভূত না হয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখো, অন্তত একটি বর্ণ হলেও! জ্ঞান নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন চাণক্য সেটা হলো চর্চার মাধ্যমেই জ্ঞান বিকশিত ও প্রস্ফূটিত হয়। চাণক্য বলেন: ‘চর্চায় না রাখলে জ্ঞান হারিয়ে যায়; অজ্ঞতায় থাকলে মানুষ হারিয়ে যায়, সেনাপতি না থাকলে সেনাদল হারিয়ে যায় এবং স্বামী না থাকলে হারিয়ে যায় নারী।’
‘একজন জ্ঞানহীন মানুষের জীবন কুকুরের লেজের মতো অনর্থক/বেহুদা যেটা তার পশ্চাৎদেশও ঢাকতে পারে না আবার পোকামাকড়ের কামড় থেকেও বাঁচাতে পারে না।’
ধন-সম্পদ, আহারাদি, বস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদির বেলায় অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা বলা হলেও জ্ঞানের বেলাতে অল্পতে তুষ্ট হতে নিষেধ রয়েছে চাণক্যের। জ্ঞানহীন মানুষের জীবন খুবই জঘন্য বলে মনে করেন চাণক্য। তিনি বলেন: ‘একজন জ্ঞানহীন মানুষের জীবন কুকুরের লেজের মতো অনর্থক/বেহুদা যেটা তার পশ্চাৎদেশও ঢাকতে পারে না আবার পোকামাকড়ের কামড় থেকেও বাঁচাতে পারে না।’ জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তধন চাণক্যের কাছে। এর উপকার বহুবিধ।
সুগন্ধী বৃক্ষ যেমন পুরো বনকে সুগন্ধে ভরে ফেলে তেমনি পরিবারে একটি পূণ্যবান সন্তান পুরো পরিবারকে মহীয়ান-গরীয়ান করে তোলে। আবার একটি গাছে আগুন লাগলে যেমন পুরো বন পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে তেমনি পরিবারে একটি কুলাঙ্গার সন্তানের কারণে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন: ‘রূপ, যৌবন থাকলে ও অভিজাত বংশে জন্মালেও সেটা মূল্যহীন যদি তার জ্ঞান না থাকে।’ সুখী মানুষের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে চাণক্য বলেন: ‘যে ব্যক্তি আর্থিক লেনদেনে, জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে, খাওয়া ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে লজ্জা ছেড়ে দেয় সে সুখি হয়।’
![]()
চাণক্যনীতি ও নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স একসাথে পড়া যেতে পারে। রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে দুটি বই খুবই প্রাসঙ্গিক ও বেশ মিল রয়েছে তাদের মধ্যে। এছাড়া মহাভারতের গীতা অংশ ও ভীষ্মের উপদেশগুলো পড়া যেতে পারে। রাষ্ট্রনীতি ও ব্যক্তিগত জীবন ব্যবস্থাপনায় এগুলো খুবই উপকারী বলে মনে হবে। ক্লাসিক চিরায়ত বইয়ের উপর নির্দ্বিধায় আস্থা রাখা যায় এই কারণে যে সেগুলো শত শত বছর ধরে মানুষের কাজে লেগে আসছে এবং সেগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক।
চাণক্য এমন এক পণ্ডিত, দার্শনিক যে তার জীবদ্দশাতেই তার চিন্তার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পেরেছেন। গ্রীসের প্লাতো ‘দার্শনিক রাজা’ বা শক্তিশালী রাজার কল্পনা করতে পারলেও জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন দেখতে পারেননি। চাণক্য সেখানে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পত্তনের পেছনে প্রধান দ্রষ্টার ভূমিকা পালন করেন, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন আর তার মৃত্যুর পরও তার চিন্তা মৌর্য্য সাম্রাজ্য ও তৎপরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে অনেক প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
আধুনিক ভারতবর্ষও চাণক্যের প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি।
৬. দ্য প্রিন্স-নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি
প্রিন্স চাকুরীর জন্য আবেদনপত্র। ম্যাকিয়াভেলি যে একজন দক্ষ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং সে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা ভালো বুঝে সেটা দেখানোর প্রয়াসে লরেনজো দে মেডিসিকে উৎসর্গ করে প্রিন্স লিখেন। খুবই ট্রাজিক বিষয় হচ্ছে যাকে উদ্দেশ্য করে সেটি লিখেছিলেন সে পড়তে ও উপকৃত হতে পারেনি বলেই মত্ কারন বছর দুয়েকের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এরপর অপর আরেকজন প্রিন্সকে উৎসর্গ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেও নাকি মারা গিয়েছিল। মানে ম্যাকিয়াভেলি মারা যান বেশ ব্যর্থ মানুষ হয়েই। নিজের বইয়ের এরকম সফলতা দেখা তো দূরের কথা তার চিন্তার সফল প্রয়োগটা তিনি নিজে দেখে যেতে পারেননি। অথচ শত শত মানুষ অনুপ্রেরণা নিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে।
‘ডিসকোর্সেস অন লিবি’ লিখতে গিয়ে প্রিন্সের কথা মাথায় আসে। আসলে তখন তার চাকুরী দরকার ছিল। সে যে রাষ্ট্র কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সক্ষমতা রাখে সেটা দেখানোর জন্য প্রিন্স লেখা শুরু করেন। মাত্র তিন মাসে সেটা লেখা শেষ করেন বলে জানা যায়।
![]()
বইটি নিয়ে আরেকটা মজার তথ্য হচ্ছে এটার নাম দ্য প্রিন্স বা প্রিন্সিপালিটিজ কিছুই রেখে যাননি ম্যাকিয়াভেলি। তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এটা প্রকাশিত হলে সম্পাদকরা এমনতর নাম রাখেন।
বইটি মূলত দুটি মূল থিমের উপর লেখা/আবর্তিত:
১. কীভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়
২. কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়
বইটির প্রথম অর্ধভাগে ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন আর শেষ অর্ধভাগে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন। এটা হলো সহজ বিভাজন।
এথিক্স ও থিওলজি থেকে রাজনীতির জুদা ঘোষণা করেছেন ম্যাকিয়াভেলি।প্রায় দেড় যুগের মতো কূটনীতিক/দূত হিসেবে ইউরোপের প্রধান শক্তিঘর এবং তাদের প্রধান চরিত্রদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন ম্যাকিয়াভেলি। পাওয়ার কিভাবে আচরণ করে, এর সত্যিকার স্বরূপ তা সরাসরি দেখেছেন। তাকে নাস্তিক বলা হলেও সে বিশ্বাসী খ্রিস্টানই ছিলেন। তবে তার আলোচনায় ধর্মকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতির আসল রূপটা এবং ক্ষমতায় সফল হওয়ার ফর্মূলা জানিয়েছেন।
সিজার বোর্গিয়ার কর্মকাণ্ড খুব গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। সফল শাসকদের কিছু গুণের সামঞ্জস্য দেখতে পেয়েছেন।
বইটির মাধ্যমে চাকুরী খুজেছেন ম্যাকিয়াভেলি কিন্তু এর মাধ্যমে রাজনীতিবিজ্ঞানের ইতিহাসে বেশ সম্মানের জায়গা নিয়ে ফেললেন। ম্যাকিয়াভেলি তার সে সফলতা দেখে যেতে পারলেন না সেটা ট্রাজিক ঘটনা।
সিসেরো দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। গদ্যে সেই গতি ও সৌন্দর্য ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৬শ শতকে ইউরোপে ঘৃণিত হয়ে আসলেও খুব শীঘ্রই ম্যাকিয়াভেলির মান বাড়তে শুরু করে। বিখ্যাত কয়েকজন দার্শনিক এটার ভালো ব্যাখ্যা দাড় করান। দার্শনিক স্পিনোজা তার ‘ট্রেকটেটাস থিওলজিকো পলিটিকাস’ বইয়ে ম্যাকিয়াভেলিকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব লিবার্টি’ বলেছেন।
এদিকে ফরাসী বিপ্লবের তিন কারিগরের দুজন খুবই সমীহ করেছেন ম্যাকিয়াভেলিকে। রুশো তার বিখ্যাত ‘সোস্যাল কনট্রাক্ট’ বইয়ে বলেন: ‘তিনি আসলে শাসকদের উপদেশ দেওয়ার বান করে সাধারণ জনতাকে দীক্ষিত করছেন।’
ফরাসী বিপ্লবের অপর ইঞ্জিনিয়ার দিদেরো তার ‘এনসাইক্লোপেডিয়া’ বইতেও ম্যাকিয়াভেলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সমসাময়িকরা যে তার সাথে ভুল আচরণ করেছে সেটার কথা বলতে গিয়ে দিদেরো বলেন: ‘তারা (ম্যাকিয়াভেলির সমর্থকরা) যদি ভুল বুঝে তাহলে এটা তাদের দোষ কারণ তারা একটি স্যাটায়ারকে ইউলজি বা প্রশংসাবাণী মনে করেছে।
আমাদের সময়কালের কয়েকজন আলোচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে ম্যাকিয়াভেলির ছকে ফেলে দেওয়া যাবে। দেখা যাবে তারা কিভাবে ম্যাকিয়াভেলির চিন্তার প্রতিমূর্তি। ভ্লাদিমির পুতিন এর ক্যারিয়ার অভিযানে নজর দিলে দেখবো ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাকে। ট্রাম্পের উত্থানে দেখবো ম্যাকিয়াভেলি, টনি ব্লেয়ার তার পুরো ক্যারিয়ারে বারে বারে ম্যাকিয়াভেলিয়ান হিসেবে গালির শিকার বা সমীহের ভাগিদার হয়েছেন। টনি ব্লেয়ারের প্রথম বছরে ম্যাকিয়াভেলিয়ান শব্দটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ৩৫৮ বার উচ্চারিত হয়েছে ।
রিচার্ড নিক্সন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিনজারের বিছানার পাশে একখণ্ড প্রিন্স থাকতো বলে জানা যায়। আর ফ্যাসিবাদী নেতা ইতালীর মুসোলিনি ‘দ্য প্রিন্স’ এর উপর থিসিস করেছিলেন। ইতালীর কমিউনিস্ট চিন্তক ও নেতা আন্তোনিও গ্রামসি।
নেপোলিয়ন ‘প্রিন্স’ পড়েছেন, স্টালিন তার মার্জিনে মন্তব্য লিখেছেন, মুসোলিনি এর উপর তো থিসিসই লিখে ফেলেছেন। হেনরি কিসিঞ্জারকে তো তার ভক্ত বা সমালোচকরা আমেরিকার ম্যাকিয়াভেলি বলে থাকেন।
দক্ষ ডাক্তারের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের বিভিন্ন রোগবালাই এবং সেগুলো থেকে আরোগ্য লাভের উপায় বাতলে দিয়েছেন। তার যুক্তি সহজ ও স্পষ্ট। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় তেমনি রাষ্ট্রীয় রোগবালাই সমাধানে প্রাথমিক স্তরেই হাত দিলে সমাধান আসতে পারে। বেশি ঘনিয়ে গেলে রোগ মুক্তি যেমন সম্ভব নয় তেমনি যদি প্রথমদিকেই সমস্যা সমাধানে হাত না দেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রের ভয়াবহ পরিণাম এড়ানো সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন শাসকের অনেক অস্ত্র বা ছলাকলা থাকে। তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে ভয়। ভালোবাসা ও ভয়ের মধ্যে যদি একটা গ্রহণ করতে বলা হয় তাহলে শাসককে ভয়ের অস্ত্র হাতে নেয়ার তালিম দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি।
রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন শাসকের অনেক অস্ত্র বা ছলাকলা থাকে। তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে ভয়। ভালোবাসা ও ভয়ের মধ্যে যদি একটা গ্রহণ করতে বলা হয় তাহলে শাসককে ভয়ের অস্ত্র হাতে নেয়ার তালিম দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি। এছাড়া যুদ্ধকে একজন শাসকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন ম্যাকিয়াভেলি। সান জুর মতো তার বইটির নামও ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’। একই সঙ্গে ম্যাকিয়াভেলি প্রচলিত সামরিক ব্যবস্থার বদলে নতুন সামরিক বাহিনীর আইডিয়া দেন। আধুনিক রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর ধারণা অনেকটা ম্যাকিয়াভেলির কাছ থেকেই পাওয়া। এর আগে বিভিন্ন শাসক সৈন্যদলের জন্য মার্সিনারি সেনাদলের উপর নির্ভর করতেন। ম্যাকিয়াভেলি তার প্রিন্সে দেখিয়েছেন কিভাবে এটা ক্ষতিকর হতে পারে। নিজ ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের দিয়েই সেনাদল গড়তে হবে। এটা অনেক শক্তিশালী ও দৃঢ় বলে মনে করেন তিনি। জনতাকে নিরস্ত্র করার মেডিসিয়ান পলিসি দেশকে দুর্বল করে দেয়। ম্যাকিয়াভেলি দেখেছেন কিভাবে ইতালিয়ান শহরগুলো ফ্রান্স, স্পেন বা অন্যান্য শক্তিশালী রাজের দখলে চলে যেতো।
আজকের কোন তরুণ কেন প্রিন্স পড়বে, আপনি কেন পড়বেন-এই প্রশ্নগুলো আসলে বলতে হবে:
আপনি পড়েন বা না পড়েন আপনার বিরোধি শক্তি সেসব অনুসরণ করে যার কথা ম্যাকিয়াভেলির মতো লোকেরা বলে গেছেন। প্রত্যেকেই যে যেখানে আছেন না কেন আপনি যদি বেঁচে থাকেন বা বেঁচে আছেন বলে মনে করেন নিজেকে বক্সিং রিংয়ে আবিষ্কার করবেন।
আপনার সামনে অপশন সীমিত। যুদ্ধ করতে হবে, হামলা ঠেকাতে হবে। তা না হলে আপনি প্রথমেই নকড ডাউন হয়ে পৃথিবীর লড়াইয়ে টিকে থাকার সক্ষমতা হারাবেন। এখন ম্যাকিয়াভেলির শিক্ষা রাজনীতি, খেলাধূলা, সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, প্রযুক্তির দুনিয়া, এমনকি যেকোন কর্পোরেট হাউসে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আপনার ভাবের দুনিয়া, কল্পনার দুনিয়া, নৈতিকতার দুনিয়া যেমনটাই হউক না কেন, যেভাবেই আপনি দেখতে চান না কেন নির্মম বাস্তবতার ছবিটি এঁকেছেন ম্যাকিয়াভেলিরা।
পৃথিবী নামক যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি না হয় আগ্রাসী হামলাকারী হলেন না কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে আসা হামলা এড়াতে বা ঠেকাতে ম্যাকিয়াভেলিকে খুব আপনজন হিসেবে পাবেন। এটা যেকোন ব্যক্তির জন্য, যেকোন প্রতিষ্ঠানের জন্য আর যেকোন রাষ্ট্রের জন্য আরও বড় করে সত্য!
৭. দ্য লিটল প্রিন্স- অতোঁয়ান দ্য স্যান্ত একজুপেরি
গত শতকটি ছিল মানুষের জন্য আকাশে পাখা মেলার শতক। বিশ শতকের একেবারে গোড়াতেই প্রথমবারের মত মিলিয়ন বছরের এই স্বপ্নটি সফল করে মানুষ। বিমান আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে এই অনন্য ঘটনাটির জন্ম দেয়। দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধে মানুষের উপর হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার কিংবা দুটি পারমানবিক বিষ্ফোরণের কাজে ব্যবহার করা হলেও এটি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ উল্লম্ফনের একটি। মনে রাখতে হবে আকাশে উড়ার প্রযুক্তি আসার সাথে সাথে তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টর একটি বড় লাফ দিয়েছে। খুব দ্রুতই এটা উন্নততর ও বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। এই বিমান চালু হওয়ার প্রথমদিকে যারা বিমান চালাতেন তারা ছিলেন সমকালের নায়ক। প্রথমদিকে বেশি বিমান দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে বিমান চালনার পেশাতে যারা আসতেন তাদেরকে দু:সাহসী হিসেবেই দেখা হতো। এখনকার সময়ে মহাকাশে যারা কয়েকমাস বা বছরব্যাপী থাকেন তারা যেমন বড় তারকা হিসেবে স্বীকৃত হন সে সময়ে বিমানের পাইলটরা ছিলেন এমন।
![]()
অঁতোয়ান দ্য স্যান্ত একজুপেরি হচ্ছেন প্রথমদিককার এমন একজন পাইলট। সে সময়ে বিমান চালনা এবং আকাশযান বিষয়ক গল্প বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন সায়েন্স ফিকশন এবং নভোজান বিষয়ক গল্প-সিনেমা যেমন জনপ্রিয়। ক্ষুদে যুবরাজ বা দ্য লিটল প্রিন্স স্রেফ বিমান সম্পর্কিত গল্প হওয়ার কারণেই এত জনপ্রিয় নয়। এর সাথে রয়েছে দর্শন, কাব্য, রহস্য ও অভিযানের মসলা।
এই নভেলাটি ফরাসী ভাষায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ও বেশি অনূদিত বই হিসেবে স্বীকৃত। বিশ শতকে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এটি। এটি একই সাথে নৈতিক অ্যালিগরি আবার আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী। মোহনীয় বর্ণনায় আমরা দেখি কিভাবে দূরের কোন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে পতিত হয় একটি ছোট্ট ছেলে, যে গল্পের ক্ষুদে যুবরাজ। আমীর খানের ‘পিকে’ মুভির কথা মনে আসবে সেটি বলাই বাহুল্য। সেরকমই অনেকটা। দূর কোন গ্রহ থেকে এই ক্ষুদে যুবরাজ চলে এসেছেন এই পৃথিবীতে যে কীনা এই অদ্ভূতরে দুনিয়ার চালচলন কিছু বুঝে না। একজন বয়স্ক বৈমানিক ক্ষুদে যুবরাজকে বিভিন্নভাবে দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। বড়দের দুনিয়ায় ক্ষুদে যুবরাজের শিক্ষণীয় ভ্রমণের কথা পাবো বইটিতে। প্রতিটি মানুষের জীবনে কি কি দার্শনিক অভিঘাত আসতে পারে তার ইশারা আছে এই গ্রন্থে। বইটিতে রয়েছে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ভালোবাসা নিয়ে আছে অবিস্মরণীয় কিছু উক্তি। সব ধরণের পাঠকদের জন্যই মসলা নিয়ে হাজির এই ‘ক্ষুদে যুবরাজ’।
৮. সক্রেতিসের জবানবন্দি-প্লাতো
সক্রেতিসের বাবা ভাস্কর আর মা ধাত্রী। সক্রেতিস পরবর্তী জীবনে মা-বাবার পেশাকে ধরে রেখেছেন বলে মনে করতেন। ধাত্রী যেমন কোন মানবশিশুকে পৃথিবীতে আসতে, জন্ম নিতে সহায়তা করতেন সক্রেতিসও তেমনি একজন জ্ঞানপিপাসুর জন্মের ক্ষেত্রে ধাত্রীর মতো ভূমিকা পালন করতেন। আবার একজন ভাস্কর যেমন কঠিন পাথরকে কেটেকুটে সুন্দর মূর্তির রূপ দেন তেমনি দার্শনিক সক্রেতিস ও একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে নিপুণ ভাস্করের ভূমিকা পালন করেছেন। বৃক্ষ তোমার নাম কি-ফলে পরিচয়। এখন সক্রেতিস কেমন শিক্ষক ছিলেন তার প্রমাণ প্লাতো, অ্যারিস্টোটলদের মতো ওস্তাদদের পরম্পরা। তার প্রিয় এবং যোগ্যতম শিষ্যকে নিয়ে বলা হয়-‘পুরো পাশ্চাত্য দর্শন প্লাতোর ফুটনোট মাত্র’।
![]()
প্লাতোর প্রত্যেকটি লেখাতে প্রধান চরিত্র হিসেবে থেকেছেন সক্রেতিস। মনে হচ্ছে যেন সক্রেতিস কথা বলছেন আর প্লাতো নোট লিখছেন। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বয়স ত্রিশের দিকে গুরু সক্রেতিসের করুণ বিয়োগের ঘটনাটি এমনভাবেই তাড়িত করেছিল তরুণ প্লাতোকে যে সে তার পুরো জ্ঞানচর্চাকেই সক্রেতিসের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার প্লাতো প্রথমদিকে হয়তো সক্রেতিসের দর্শনই সক্রেতিসের মুখ দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার সেরা লেখাগুলোতে বা শেষদিকের লেখাগুলোতে নিজের দর্শন সক্রেতিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। সক্রেতিসের প্রতি তার একাত্ম আনুগত্য ও ভালোবাসার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের লেষমাত্র নেই।
‘সক্রেতিসের জবানবন্দি’তে এথেন্সের আদালতে দাড়িয়ে নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যুক্তির হাতুরি দিয়ে নিপুণভাবে খণ্ডন করেছেন সক্রেতিস। আদালতের সামনে তার পুরো জীবনের ভ্রমণটাও তুলে এনেছেন। সত্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি তার একনিষ্ঠতার প্রমাণ ঠিকরে বের হবে প্রতিটি উক্তিতে। সক্রেতিসকে খুব কাছ থেকে বুঝতে হলে তার জবানবন্দি পড়তে হবে। এর একাধিক বাংলা তর্জমা আছে। ইংরেজিতেও অনেকগুলো সংস্করণ আছে। যেকোন একটা পড়ে ফেলতে পারেন।
৯. দি হানড্রেড- মাইকেল এইচ হার্ট
![]()
আমার প্রিয় শিক্ষক উইল ডুরান্টের কথায় বলতে হয় ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’। বড় মানুষদের জীবন আমাকে বেশ টানে। এজন্য জীবনী, আত্মজীবনী, বড় মানুষদের কথা আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য বিষয়। মাইকেল এইচ হার্টের এই বিশ্বখ্যাত বইটিতে একসাথে একশো জন মহামানবের উপস্থিতে বইটিকে আমার কাছে অনেক আকর্ষনীয় করে তুলেছে। এজন্য মাঝে মাঝে এই বইটা থেকে কয়েকজন মহামানবের জীবনের উপর দিয়ে একটু ভ্রমণ করে আসি। মহামানবদের জীবন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে যে যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন সেগুলো আমাদের দৃষ্টি খুলে দেবে। তার সাথে দ্বিমত করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তার যুক্তির কাছে বশ মানা ছাড়া সুযোগ খুবই সীমিত।
১০. হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-বাট্রার্ন্ড রাসেল
দর্শনের জগতে ঘুরে আসার জন্য একটি অসাধারণ বই। ইংরেজি ভাষার একজন অসাধারণ গদ্যশিল্পী বাট্রার্ন্ড রাসেল। তিনি নিজেও একজন শক্তিশালী দার্শনিক এবং দর্শনের সেরা শিক্ষকদের একজন। তার কাছ থেকে তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের গল্প শুনা একটি অসাধারণ সুযোগ। বইটি সকল সিরিয়াস পাঠকের অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। রাসেলের গদ্য যেমন পাঠককে টানবে এবং প্রত্যেক দার্শনিককে নিয়ে করা তার মন্তব্য আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে।
![]()
দর্শনের ইতিহাসের উপর আরও যে কয়েকটি বই ভালো লেগেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্যামুয়েল ইনূচ স্টাম্ফের ‘সক্রেতিস টু সার্ত্রে: অ্যা হিস্ট্রি অব ফিলসফি’, ফ্রাঙ্ক থিলি’র ‘এ হিস্ট্রি অব ফিলসফি’ এবং উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’। সময় ও সুযোগ থাকলে সবগুলোও পড়া যেতে পারে। তবে একটা দিয়ে যদি শুরু করতে চান তাহলে রাসেলকেই নিতে পারেন।
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ও এবং তার মৌলিক বিষয়াদির সঙ্গে পরিচয় লাভের জন্য অন্য আরেকটি বই বেশ ভালো লেগেছে সেটি হলো: রালফ ম্যাকলনার্নির ‘এ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’। প্রায় সাড়ে আটশো পৃষ্ঠা প্রলম্বিত এই বইটির সবচেয়ে ভালো লাগার দিক হচ্ছে এর টসটসে ভাষা! ভাষা যেহেতু কোন বইয়ের জগতে প্রবেশের দরজা এ কারণে এ বইয়ে খুব সহজেই প্রবেশ করে ফেলতে পারবেন! সাইজ দেখে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এক সপ্তাহ বা পনের দিন পড়ে যদিও এটা শেষ করতে পারা যায় তাহলে সেটা হবে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বইটির বরাতে বেড়িয়ে আসতে পারবেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্দরমহলে এবং জেনে নিতে পারবেন এর হাড়ির খবর!
আমরা বইপত্র পড়ি নিজেকে বুঝার জন্য, নিজেকে জানার জন্য। পড়া শেষ হলে আপনার আসল কিতাবের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি নিজেই হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।
আমরা বইপত্র পড়ি নিজেকে বুঝার জন্য, নিজেকে জানার জন্য। পড়া শেষ হলে আপনার আসল কিতাবের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি নিজেই হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব যা মনোযোগ সহকারে পাঠ ও অনুধাবন অনেক প্রয়োজনীয়।
পড়া শেষ হলে চলেন সামনে আগাই-
The post আমার পড়া সেরা ১০ টি বই appeared first on Bangladesh Study Forum.