Quantcast
Channel: Bangladesh Study Forum
Viewing all 635 articles
Browse latest View live

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিডিএসএফ’ এর নতুন কমিটি ঘোষণা

$
0
0

পৌষের ক্রান্তি লগ্নে তীব্র শীতের অবগাহনে সকালের সূর্য যখন আলো ছড়াচ্ছিলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারিধারে ঠিক তখনই ‘বিডিএসএফ কুবি’ টিমের আড্ডায় জ্ঞানের আলোয় প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে  ‘ফরেস্ট অব আর্ডেন’। বুধবারের এই আড্ডায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম’ এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাবিদিন ইব্রাহিম এবং যুগ্ম সম্পাদক সাগড় বড়ুয়া।

বাংলাদেশের চোখে বিশ্ব দেখার স্বপ্ন নিয়ে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেধাবী তরুণ তুর্কিদের দ্বারা পরিচালিত আড্ডার আজকের পর্বের আলোচনায় উঠে আসে জীবন দর্শনের হাজারো দিক। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকার লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে অন্যান্য ব্যক্তিদের মহত্ত্ব ও অমরত্ব লাভের মূলমন্ত্র, জীবনের বিভিন্ন টানাপোড়েন-হতাশা, বিষাদ, অপ্রাপ্তির মুহূর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুভূতি এবং হতাশা কাটিয়ে উঠার উপায়।

প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝেই সুপ্ত থাকে মহৎ গুণের বীজগুলো, তবে সময়ের প্রয়োজনে সেগুলোকে জাগিলে তুলতে হয়, মেলে ধরতে হয় নিজের নৈতিকতা এবং মানবিকতাকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্বভ, এমন সব সময় উপোযোগী সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়েছে পুরো আড্ডা জুড়ে।
এছাড়া শীতের পড়ন্ত বিকেলের ঝটিকা আড্ডায় বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস, তৎকালীন মানুয়ের ধর্মীয়, নৈতিক, এবং আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, বৌদ্ধ মহাযান থেকে তান্ত্রিকবাদ, ভিক্ষুদের শিষ্যত্ব এবং বৌদ্ধ ধর্ম কীভাবে বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসি হয়ে হিন্দুধর্মের সাথে মিশ্রিত রূপ ধারণ করে তা নিয়ে চলে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং তথ্যনির্ভর আলোচনা।

তবে বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম কেন্দ্রিয় টিমের এই শীতের সফরের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিডিএসএফ কুবি টিমকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে নিত্যনতুন কর্ম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে উজ্জীবিত করা। এবং সে লক্ষ্যেই ‘বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যায়ে’র নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় যাদের নেতৃত্বে আগামী এক বছর কাজ করবে :

১) সভাপতি — হাফছা জাহান
২) সহ-সভাপতি — আব্দুল আজিজ, শাকিল মাহমুদ, কাশফি সাউদিয়া
৩) সাধারন সম্পাদক — মো: আনোয়ার হোসেন
৪) সাংগঠনিক সম্পাদক — ফয়সাল আহমেদ
৫) অর্থ সম্পাদক — সাময়িকভাবে সভাপতির নিয়ন্ত্রনে
৬) প্রচার সম্পাদক — মো: ইউসুফ হোসেন
৭) দপ্তর সম্পাদক — মো: এমদাদুল এইচ সরকার
৮) তথ্য ও প্রযুক্তি — মো: জহিরুল ইসলাম সাদিক
৯) পাঠাগার ও গবেষণা — মাহের রাহাত
১০) ডকুমেন্টেশন — জান্নাতুল ফেরদৌস
১১) সংস্কৃতি ও ভ্রমণ — জাহেদ নয়িম ও সাকিব আল হাসান
★ নির্বাহী সদস্য :
১২) মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ।
১৩) জান্নাত রুহি।
★ সিনিয়র নির্বাহি সহযোগী সদস্য:
১৪) নিরুপম নিরু
১৫) তাসলিমা আক্তার।
১৬) মাহমুদুল হাসান।
১৭) মো: আতিকুর রহমান।

★বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম স্রেফ পদভিত্তিক সংগঠন নয়, এটা জ্ঞানভিত্তিক সংগঠন। পদ নয় জ্ঞান আগে। পদ কাজকে চালিয়ে নেয়ার জন্য। আপনাদের অসাধারণ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখুন, আমাদেরকে সমৃদ্ধ করুন, দেশ ও বিশ্বকে আলোকিত করুন!

The post কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিডিএসএফ’ এর নতুন কমিটি ঘোষণা appeared first on Bangladesh Study Forum.


আখতার হামিদ খান: পল্লী উন্নয়নের কারিগর

$
0
0

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) এবং ডা. আখতার হামিদ খান নাম দু’টো একে অপরের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তান এবং একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে বার্ড এর অবদান না বললেই নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের আগে জানতে হবে আখতার হামিদ খান-কে। ড. আখতার হামিদ খানের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ই জুলাই, ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বেরিলি (আগ্রা) নামক স্থানে। ইংরেজ শাসনামলে একটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া আখতার হামিদ খানের পারিবারিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, তাঁর পিতামহ স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান তৎকালীন বৃটিশ ভারতের একজন সাব ইনসপেক্টর। যিনি ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কলেজ (যা পরবর্তিতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়) স্থাপন করেন এবং মুসলমানদেরকে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার বিনষ্ট না করে কীভাবে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের উন্নয়ন সাধন করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেন। একজন সংস্কারবাদী ও সমন্বয়সাধনকারী দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন সৈয়দ আহম্মদ খানের মৃত্যুর ষোল বছর পরে জন্ম নেওয়া ড. আখতার হামিদ খানও একই চিন্তা ভাবনার অনুসারী ছিলেন।

একজন সৎ পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা ও পর্দানশীন শিক্ষিতা মা বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান আখতার হামিদ খান। পিতার ন্যায়পরায়ণতা ও মাতার আধুনিক সমন্বয়বাদী চিন্তাধারার এ সম্মিলন ঘটে আখতার হামিদ খানের জীবনে। তাঁর পরিবার শুধু স্বচ্ছল ও মধ্যবিত্ত ছিলনা, ছিল শিক্ষিত চিন্তাশীল, সমসাময়িক পৃথিবীর প্রতি অনুসন্ধিৎসু এবং সর্বোপরি স্যার সৈয়দ আহম্মদ খানের সংস্কার আন্দোলন ও ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রায় প্রতি পরীক্ষায় প্রথম সারির পদ দখল করা আখতার হামিদ খান দর্শন ও ইতিহাসে বি.এ পাশ করেন। এবং পরবর্তীতে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একুশ বছর বয়সে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন। দর্শন পাঠকালে তিনি জার্মান দার্শনিক নীটশের ভক্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দার্শনিক ইকবাল এর প্রতিভা এবং চিন্তাধারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। নীটশের ভক্ত হওয়ার কারণেই যৌবনে তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিলেন তা নয়, বরং পাঠান রক্তের অধিকারী হয়ে বিরাট কিছু করার তাড়না অনুভব করেন তিনি।

পিতা পুলিশ অফিসার হওয়ার সুবাদে কাছ থেকেই আখতার হামিদ খান বৃটিশদের সততা, শৃঙ্খলা, ন্যায়পরায়ণতায় মুগ্ধ হন এবং পিতার ইচ্ছায় ১৯৩৪ সালে তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক, মর্যাদাপূর্ণ আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি লাভ করেন। এরপরে ১৯৩৬ সালে একদিন আইসিএস প্রবেশনার হিসেবে বিলাতে চলে যান। সেখানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজের আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট ছাত্রদের সাথে একত্রে পড়াশোনা শুরু করেন। এবং তাঁর ‘মাই ট্রাবল্‌ড লাইফ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিনি সমসাময়িক পৃথিবী ও পৃথিবীব্যাপি সমস্যা এবং বিশেষ করে ইংরেজদের সমস্যা এবং সমাধান বিভিন্ন পত্রপত্রিকার আলোচনা ও সভার মাধ্যমে জেনে নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রবাদের উত্থান ও বিশ্ব পরিস্থিতি কাছ থেকে অবলোকন করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বিয়ে করেন তারই দীক্ষাগুরু আল্লামা মাশরেকীর মেয়েকে। পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্ত্রীর আধুনিক চিন্তাচেতনা এবং সংস্কারবাদী মননের পরিচয় পান। পঞ্চাশের মন্বন্তর চলাকালে ১৯৪৩ সালে নেত্রকোনায় তিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির আসল রূপ কাছ থেকে দেখেন। এই সময় সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁর মধ্যে একটি প্রতিবাদী মন গড়ে ওঠে, যার প্রকাশ মেলে পরবর্তী কালে তাঁর নয় বছরের আইসিএস চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে। প্রসঙ্গক্রমে এ কথা বলা যায়, ড.আখতার হামিদ খান তাঁর জীবনে দুই বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন এবং যুদ্ধের ফলেই সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে, যা আখতার হামিদ খানের সচেতন চোখে ধরা পড়ে। কর্মক্ষেত্রে তিনি তখন ছিলেন একজন বড় বুরোক্রেট কিন্তু মনেপ্রাণে একজন আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক, সর্বোপরি একজন সমাজবিজ্ঞানী।

ইম্পিরিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন এর এমন সম্মানজনক চাকরি কি কেউ এমনি করে ছেড়ে দেয়? বিশেষ করে মুসলমানদের কেউ? উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারতবর্ষে মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের সন্দেহ ও বিদ্বেষ পরায়ণনীতির দরুণ খুব কম সংখ্যক মুসলমান সিভিল সার্ভিসে চাকরি পেতো। চিফ সেক্রেটারির অনুরোধকে রীতিমতো উপেক্ষা করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন ভারতবর্ষের আলীগড়ের কাছে অজপাড়াগাঁ মামুল-এ। ঘর ভাড়া নিয়ে চাষের জন্য বর্গা নিলেন একখণ্ড জমি। গাভী, মহিষ, আর পরিচারিকা সহযোগে কৃষকের জীবন ধারণ করলেন তিনি। আখতার হামিদ খান নিজেই একে টলস্টিয়ান পরীক্ষা বলে আখ্যায়িত করেছেন। চাষাবাদের জীবনে ন্যুনতম আয় দিয়ে জীবন যাপনের অসহায়ত্ব আখতার হামিদ-কে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেনি, তবে কৃষক হিসেবে বুঝতে পারলেন ভারতবর্ষের কৃষকদের অগণিত সমস্যা। তাঁর মাথায় কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য আসে গ্রামভিত্তিক সমবায় তৈরি করে পুঁজি গড়ার মাধ্যমে কৃষকের আয় বাড়ানো, যা কৃষকদের অনাকাঙ্ক্ষিত শোষণ থেকে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।

এরপর, কৃষক জীবনে ব্যর্থ আখতার হামিদ ছাপাখানার শ্রমিক হয়েছিলেন, হয়েছিলেন তালা চাবির কারিগর। দুই বছরের এই কঠোর জীবনে অসফল হওয়া আখতার হামিদ খান দমে যান নি। একদিন এসব ছেড়ে দিল্লীতে জামিয়া মিলিয়া নামের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে, ভারতবর্ষ থেকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিদায় সূচিত হতে চলা পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে ও ভারতীয় মুসলমানদেরকে ভিন্ন পরিবেশে আবিষ্কার করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান পাকিস্তানের দিকে ছুটতে থাকে। দাঙ্গার ধাক্কা সয়েও টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা আখতার হামিদ বাধ্য হয়ে ১৯৫০-এ পাকিস্তানে চলে আসেন সামান্য শরণার্থী হিসেবে। ১৯৪৭-১৯৫০, এই তিন বছরের সময়টুকুতে তিনি ছাত্রাবস্থায় অর্জিত স্বাধীন শঙ্কাহীনতাকে কাজে লাগাতে পারেননি। অবিশ্বাস আর আশঙ্কা তাকে বাধ্য করেছিল তার চিরপরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করতে। ‘মাই ট্রাবল্‌ড লাইফ’ নামক প্রবন্ধে তিনি দুঃখ করেই লিখেছেন, ‘জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিই আমাকে একটা গড়িয়ে পড়া পাথরের মতো চলমান করে দিয়েছিলো। এগুলো আমাকে এক ভৌগলিক অঞ্চল থেকে অন্য এক ভৌগলিক অঞ্চলে নিয়ে গেছে শক্ত চারা গাছের মতো মূলসহ তুলে। একবার নয় ,অনেকবার অন্যত্র রোপন করে গেছে’

একসময়কার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করা আখতার হামিদ খান কুমিল্লায় আবার ফিরে এলেন। দিল্লীর জামিয়া মিলিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োজিত হন তিনি। ভিক্টোরিয়া কলেজের দীর্ঘ আট বছরের কর্মজীবন কঠোর তপস্যায় ব্যয় করেন তিনি। এ সময় আল গাজ্জালী ও শাহ ওয়ালী উল্লাহর লেখা পড়ে ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন আখতার হামিদ খান। তাঁর কাছে মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্ব মনে হওয়া এসব পাঠ পরবর্তীতে তিনি অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের মধ্যে নিজস্ব চিন্তাধারা সম্পৃক্ত করতে ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম, নিউ ক্যাপিটালিজম বিষয়ক মতবাদ সম্পর্কিত বই পড়তে শুরু করেন।

প্রিন্সিপালের চাকরি করে ধর্মতত্ত্ব ও অর্থনীতি পড়তে থাকা ও সমুদয় জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়াতে ছড়াতে নিজেকে ভিন্ন এক পরিবেশে আবিষ্কার করেন তিনি। ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তাকে সিভিল সার্ভেন্টদের শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব দেন। আগে ‘ভিলেজ এইড’ নামক প্রকল্পে কাজ করেছিলেন বিধায় সানন্দে এই চাকরি লুফে নেন আখতার হামিদ খান। এরপরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বাছাই করা এগারজন ইন্সট্রাক্টর নিয়ে চলে গেলেন আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে। উদ্দেশ্য গ্রামের হতদরিদ্রদের জীবন মান উন্নয়নে আধুনিক উপায় বের করা। তিনি লক্ষ্য করেন পৃথিবীব্যাপী গ্রামগুলোর সমস্যার ধরণ একই এবং সেজন্য সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পড়াশোনা করেন এবং দেড় বছর পরে ১৯৫৯ সালে দেশে ফিরে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে যোগ দেন। কাজ শুরু করেন কোতয়ালী থানায়।

প্রথমেই আখতার হামিদ খান একাডেমীর চারপাশের প্রায় তিনশ’টি গ্রাম সহ এক’শ বর্গমাইল বিশিষ্ট কোতয়ালী থানাকে পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে ব্যবহার শুরু করেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এর সমাধানের লক্ষ্যে চালু করেন ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’। এই প্রকল্পের আওতায় মানুষ প্রথম দেখে কিভাবে ঠিকাদারি প্রথা হটিয়ে স্বল্প বাজেটে গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন বাড়ানো যায়। এবারে রোষানলে পড়েন ঠিকাদার ও সুদখোর মহাজনদের। তাকে কুমিল্লা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করা হয়। ওয়ার্কার্স প্রোগ্রামের ফলে সাড়া পড়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। গ্রামবাসীদের নিয়ে অনবরত আলোচনা পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল স্বরূপ বেরিয়ে আসে নানান সমস্যা। সেসবের সমাধানের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন সমবায় সমিতি। সর্বস্তরের কৃষকদের উন্নয়নের পথ অনেকটাই সুগম হতে শুরু করে। সাফল্য পায় আমাদের আখতার হামিদের প্রচেষ্টা। হার্ভার্ড উপদেষ্টাগণ আখতার হামিদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারকে কুমিল্লা পদ্ধতি অন্যান্য থানায় পুনরাবৃত্তি ঘটাতে রাজি করায়। যার ফলে ১৯৬১ সালে ‘থানা ট্রেইনিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট ও ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’ ৪১৭ টি থানায় শুরু হয়। পরের বছর ২৫০টি থানায় থানা কো-অপারেটিভ ও সেচ প্রোগ্রাম শুরু হয়। আর এভাবেই সাফল্য পায় ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, এবং সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন প্রোগ্রাম আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে।

আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর আদলে নির্মিত হয়েছিল বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী। আখতার হামিদ খান ও পল্লী উন্নয়ন যেন একে অপরের সাথে ওতপ্রেতভাবে জড়িত। যদি কুমিল্লায় তাঁর অবদান গুলোকে একে একে জড়ো করা হয়, তবে যে বিষয়গুলো উঠে আসে তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয়, পল্লীর মানুষের জন্য পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় অবদান যদি বলি তাহলে তা, গ্রামের মানুষের সমস্যা ও তার সমাধান খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা প্রবর্তন করা। সম্ভবত গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়েও যে গবেষণা হতে পারে এমন চিন্তা তিনিই প্রথম করেছিলেন। তৃতীয়ত আসে থানাভিত্তিক ট্রেনিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা। সমগ্র সার্কেল অফিসার, থানা শিক্ষা অফিসার, কৃষি অফিসারসহ অন্যান্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অফিস এবং অফিস কর্মকর্তাদের এক ছাদনাতলায় এনে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটা আখতার হামিদের হাত ধরেই হয়েছিল।

তাঁর চতুর্থ অবদান- রাস্তা তৈরি ও খাল খননের ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, যার উদ্দেশ্য সমগ্র এলাকাজুড়ে রাস্তা ও খালের একটি নেটওয়ার্ক গড়া। পঞ্চম অবদান- সেচ কাজের ওয়ার্কস প্রোগ্রাম। এ প্রকল্পের আওতায় প্রথম বসানো হয় গভীর নলকূপ, লিফট পাম্প, যা শুকনা মৌসুমে কৃষকপ্রাণে স্বস্তি দেয়। ষষ্ঠ অবদানের ক্ষেত্রে বলতে হয়- গ্রাম ও থানা ভিত্তিক কো-অপারেটিভ। পুঁজি গঠন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের সংগঠিত করেছে এই প্রকল্প। আগে কেবল ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ড ছিল। আখতার হামিদ খান প্রথম থানা কাউন্সিল নামের স্থানীয় সরকারের স্তর গঠন করেন। একে রাখব সপ্তম অবদানে। অষ্টম অবদান, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়ি বাঁধ প্রচলন, যা নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

নবম অবদানের কথা যদি বলি, তবে তা থানা ভিত্তিক পরিবার পরিকল্পনা অফিস স্থাপন ও পরিবার পরিকল্পনার আংশিকভাবে আধুনিকায়ন। এরপরে ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার সপরিবারে তুলে নিয়ে যায়। পাকিস্তানে গিয়ে তিনি দু’বছর ফয়সলাবাদ ও করাচি ইউনিভার্সিটি তে কাজ করেন। পরবর্তীতে আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলে যান, তবে এবার আর ছাত্র নয় শিক্ষকরূপে। কিছুদিন শিক্ষকতার পরে করাচিতে আসেন। এরপরে পাকিস্তানের ওরাংগিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেন একক প্রচেষ্টায়, যা ‘ওরাংগি পাইলট প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত ছিল। এখানেও সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি। একাত্তরের পর তিনি আর বাংলাদেশে আসেননি। ১৯৯৯ সালে ৯ অক্টোবর, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সুতরাং, আমরা বলতেই পারি একটি সফল জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে, কিন্তু সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাঁর অবদান কতটুকু টেকসই এবং তাঁর পদচারণার সাফল্যগুলো জন মানুষকে জানাতে প্রয়োজন বিস্তৃত গবেষণা।

তথ্যসূত্র:

১.আখতার হামিদ খান, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, কুমিল্লা। একটি স্মৃতিচারণ -মোঃ আখতার হোসেন খান

২.আখতার হামিদ খান/বাংলাপিডিয়া

 

মাহের রাহাত

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা।

The post আখতার হামিদ খান: পল্লী উন্নয়নের কারিগর appeared first on Bangladesh Study Forum.

লর্ড জিম : এডভেঞ্চার নাকি অন্তর্দ্বন্দ্বের গল্প?

$
0
0

ভ্রমনকাহিনী কার না ভালো লাগে । আর সে ভ্রমন কাহিনীতে সমুদ্রপথের দুর্গম স্থানের চমৎকার বর্ণনার সাথে যদি মনস্তাত্ত্বিক বিবরণের সম্মিলন ঘটে তাহলে তো কথাই নেই। পলিশ লেখক জোসেফ কনরাড এমনি একজন লেখক। রচনাশৈলীর গভীরতা এবং সমুদ্র ও বিভিন্ন দুর্গম স্থানের জীবন সম্পর্কে লেখার কারণে জীবদ্দশায়ই তিনি অনেক প্রশংসিত হন। তবে সমুদ্রের রোমাঞ্চকর গল্পের আড়ালে তাঁর রচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে, সেটা হচ্ছে মানব মনের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে ভাল-খারাপের দ্বন্দ্ব। ভয়ানক একাকীত্বের কারণে সমুদ্র কনরাডের কাছে একটা ট্র্যাজেডির জায়গা ছিল। যত দিন যাচ্ছে ততই তাকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন মনে করা হচ্ছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘লর্ড জিম’ (১৯০০), ‘নস্ট্রোমো’ (১৯০৪) ও ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ (১৯০৭) এবং বড় গল্প ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ (১৯০২)।

“Those who read me, know my conviction that the world … rests on a few very simple ideas … It rests, notably … on the idea of Fidelity.” — Joseph Conrad

জোসেফ কনরাডের ‘লর্ড জিম’ ঠিক এমনি একটি বই। এতে যেমন রয়েছে হতাশাপূর্ণ ও ট্র্যাজিক উপাদান তেমনি রয়েছে ভিনদেশি অদ্ভূত মোরালিটি। জর্জ ইলিয়টের ‘মিডলমার্চ’ -এ সামাজিক উপন্যাসের আড়ালে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়াস যেমন দেখিয়েছেন কনরাডের ‘লর্ড জিম’ ও তেমনি, তবে পার্থক্য হল এতে প্রধান চরিত্র লর্ড জিমের গভীর মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দ্বন্দ্ব।

‘স্ট্রিম অব কনসাসনেস’ বর্ণনাভঙ্গিতে লেখা উপন্যাসটির শুরুতে দেখা যায় জিম জাহাজে কাজ করতেন। যদিও কাজটা সহজ ছিলনা তবুও জিম তাঁর কাজে খুশি ছিল এবং সকলে তাকে ভালোবাসতো। জিমের ছোট বেলা থেকেই সাগরের প্রতি ছিল প্রবল টান । সে সাগরকেই তাঁর জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিতে চায়। তার জন্য সে জাহাজ চালানোর প্রশিক্ষনও নেয়। তারপর সে পাটনাতে নাবিক হিসেবে তাঁর প্রথম যাত্রা শুরু করে। তাঁর জাহাজটি ছিল পুরনো যা তীর্থ স্থানের জন্য বরাদ্দ ছিল। তাঁর জাহাজে ছিল আটশ মুসলিম তীর্থযাত্রী। যাত্রাপথে আরব সাগরে এক অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতে দেখা দেয় দুর্যোগ। জাহাজটির তখন ডুবো ডুবো অবস্থা। সকল তীর্থযাত্রীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে এবং তাঁর সঙ্গী নাবিকরা জাহাজটি ডুবে যাবে ভেবে লাইফবোর্ড নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জাহাজটি ডোবেনি।

তারপরের পুরো উপন্যাস জুড়ে দেখবো আমরা লর্ড জিমের অপরাধ বোধ । কোলরিজের এনশিয়েন্ট মেরিনার যেমন আলবাট্রস পাখি মেরে সারা জীবন অনুতাপ আর অনুশোচনায় ভুগেছে, তেমনি লর্ড জিম পাটনাগামী পবিত্র তীর্থযাত্রী মুসলিমদের বিপদে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার মতো ভীরু আচরণের জন্য সারা জীবন অনুতপ্ত ছিল। সাফল্য তাঁকে ধরা দিলেও অপরাধের পিছুটান তাঁকে সফল হতে দেয়নি। “Never test another man by your own weakness.” পরবর্তীতে তাঁর মার্লো নামে একজন ভালো বন্ধু জোটে। অন্তর্কোন্দলে ভোগা লর্ড জিম মার্লোকে ভালো ভাবে না দেখলেও মার্লো তাকে বন্ধু ভেবে মালাবার হাউজে ডিনারে ডাকে। পাটনা দুর্ঘটনার তদন্তে জিম চাকরি হারালে মার্লো তাঁকে চাকরীর ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু তাতেও তাঁর মনে শান্তি নেই, অতীতের অনুশোচনায়।

মার্লোর সহায়তায় সে সাক্ষাত পায় স্টেইন-এর। স্টেইন তাকে পাটুসান-এ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। পাটুসানে তাঁর ভালই কাটছিল। সেখানে জোয়েল নামে এক নারীর প্রেমে পড়ে সে, কিন্তু ঐ রমনীর প্রেমে মজেও তাঁর শান্তি মেলেনি। গল্পের শেষ দিকে অতীত অপরাধবোধ তাঁর সলিল সমাধি ঘটায়। কনরাড’র জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটে সাগর ভ্রমনে। তাই তাঁর সব উপন্যাসের প্লট সাগরকেন্দ্রিক। তবে তিনি চটকদার গল্পের খাতিরে এমন প্রেক্ষাপট নির্বাচন করতেন না, বরং তাঁর কাছে মনে হয়েছিল- জাহাজে বা কোন প্রত্যন্ত গ্রামে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে পুরো জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকে একেবারে নিজের মতো করেই সেটার সুরাহা হয়। এ কারণে অন্য সবকিছুর তুলনায় এই পরিস্থিতিগুলোকে আলাদা ও প্রকটভাবে উপলব্ধি করা যায়। তখনকার অধিকাংশ লেখকেরা বিশ্বের তাবৎ আপাত অদ্ভূত বিষয় নিয়ে লেখার মাধ্যমে সমাজের প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ হতে চেয়েছিলেন যা কনরাডের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি বিচ্ছিন্ন জগতে ট্র্যাজেডির ঘনীভবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন । যার প্রমান তাঁর ‘লর্ড জিম’

আশা করি ‘লর্ড জিম’ পড়তে আপনারা ভুলবেন না। শেষ করছি লর্ড জিম থেকে প্রিয় একটা উক্তি দিয়ে:

“And after all, one does not die of it.”

“Die of what?” I asked swiftly.

“Of being afraid.”

 

এমদাদুল এইচ সরকার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা।

The post লর্ড জিম : এডভেঞ্চার নাকি অন্তর্দ্বন্দ্বের গল্প? appeared first on Bangladesh Study Forum.

অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া: ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের স্বরূপ

$
0
0

শাসক এবং শাসিতের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না, যেটি হয় সেটি হল শাসন ও শোষণের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় ই.এম. ফরস্টারেরঅ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া‘য়। ইংরেজ শাসকদের শাসিতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ব্যর্থ হওয়ায় তাদের শাসনকার্য ভেঙ্গে পড়ে। এক পর্যায়ে এদেশ থেকে তাদের বিদায় নিতে হয়। ভারতীয়রা লাভ করে মহান স্বাধীনতা।

‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ হল ই.এম. ফরস্টারের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ইংরেজদের সাথে ভারতীয়দের সম্পর্ক বিষয়ক একটি ক্লাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটিতে উপনিবেশবাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এখানে উপনিবেশবাদীদের হঠকারী ও ধ্বংশাত্মক শাসন ও শোষিতদের করুণ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। অসাধারণ চরিত্রের চিত্রায়ন এবং চমৎকার ভারতীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতির রূপায়ন ই.এম. ফরস্টারকে করেছে তার উপন্যাসিক জীবনে অনবদ্য। আধুনিক ইংরেজি ফিকশন জগতে তার ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ হল একটি অন্যতম সেরা শিল্পকর্ম। এর প্রত্যেকটি চরিত্র, স্থান ও গল্প বলার ধরণ যেন বাস্তবিক, এবং উপযুক্ত সিম্বোলিজমের ব্যবহার ও জীবনের অনুসন্ধান, যা পাঠক ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ই.এম. ফরস্টার তার ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ উপন্যাসটি লিখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এ উপন্যাসটি প্রকাশের প্রায় একশত বছর পরেও পাঠকদের নিকট তার আবেদন ধরে রেখেছে। তাই এটি লাভ করেছে ক্লাসিক তথা সর্বযুগের সাহিত্যের মর্যাদা।

‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ (১৯২৪) ইংরেজ লেখক এডওয়ার্ড মরগ্যান ফরস্টার কর্তৃক লিখিত একটি উপন্যাস, যেটি ব্রিটিশ রাজ এবং ১৯২০ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। উপন্যাসটি মডার্ন লাইব্রেরি কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের ১০০ টি বিখ্যাত কর্মের একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়, এবং ১৯২৪ সালের জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল প্রাইজ জেতেন। টাইম ম্যাগাজিন উপন্যাসটিকে অন্তর্ভুক্ত করে “১৯২৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় লিখিত ১০০ টি উৎকৃষ্ট উপন্যাস” এর একটি হিসেবে। উপন্যাসটি ফরস্টারের ইন্ডিয়ার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত। ফরস্টার তার এই উপন্যাসের শিরোনাম নিয়েছেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের Leaves of Grass কাব্যগ্রন্থের Passage to India নামের একটি কবিতা থেকে। উপন্যাসের তিনটি পর্ব রয়েছে- মসজিদ, গুহা ও মন্দির, এবং এর গল্পটি চারটি চরিত্রের মাধ্যমে আবর্তিত হয়: ডাঃ আজিজ, তার ব্রিটিশ বন্ধু সিরিল ফিল্ডিং, মিসেস মুর এবং মিস অ্যাডেলা কোয়েস্টেড। ১৯৮৪ সালে ডেভিড লিন এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন যেটি দুইটি অস্কার এবং অসংখ্য পুরস্কার জেতে।

এডওয়ার্ড মরগ্যান ফরস্টার (১ জানুয়ারি , ১৮৭৯ – ৭ জুন , ১৯৭০) জন্মগ্রহণ করেছিলেন লন্ডন এনডব্লিউ১-এর ৬, মেলকম প্লেস, ডরসেট স্কোয়ারের একটি বাড়িতে। এই বাড়িটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্থপতি। মাত্র একবছর বয়সে ফরস্টার পিতৃহারা হন। বালক বয়সেই তাঁর বাবা পিসিমা ম্যারিন থর্নটনের থেকে ৮,০০০ পাউন্ড উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হন ফরস্টার। এই অর্থ সাহায্যের ফলে তাঁর জীবনধারণ ও পরবর্তীকালে লেখক রূপে আত্মপ্রকাশ সহজ হয়ে যায়। কেন্টের টনব্রিজ স্কুলে অনাবাসিক ছাত্ররূপে পড়াশোনা করেন ফরস্টার। ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কিংস কলেজ, কেমব্রিজ -এ পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর মায়ের সঙ্গে তিনি ইউরোপ মহাদেশ ভ্রমণ করেন। ১৯১৪ সালে ক্লাসিসিস্ট গলসওয়ার্দি লোয়েস ডিকিনসনের সঙ্গে মিশর , জার্মানি ও ভারত ভ্রমণ করেন। ১৯২০-এর দশকের প্রথম দিকে দেওয়াসের মহারাজার ব্যক্তিগত সচিব হয়ে তিনি তাঁর ভারতবাসের দ্বিতীয় পর্ব অতিবাহিত করেন। তাঁর এই সফরের বৃত্তান্ত লিখিত হয়েছে ‘দ্য হিল অফ দেবী’ নামক গদ্যরচনায়। ভারত থেকে ফিরে তিনি তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস “অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া” সমাপ্ত করেন। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ফরস্টার বিবিসি রেডিও -এর এক সফল সম্প্রচারকের ভূমিকা নেন। এই সময় ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক গণচরিত্রও হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৩৭ সালে তিনি সাহিত্যে ‘বেনসন’ মেডেলে ভূষিত হন। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে কিংস কলেজ, কেমব্রিজের সাম্মানিক ফেলো নির্বাচিত হন ফরস্টার। ১৯৪৯ সালে তাঁকে ‘নাইটহুডে’ ভূষিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে ‘অর্ডার অফ দ্য কমপ্যানিওন অফ অনার’ সম্মান দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘ব্রিটিশ অর্ডার অফ মেরিট’ সদস্যের মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ৭ জুন, ৯১ বছর বয়সে কভেন্ট্রিতে তাঁর বাকিংহ্যামসস্থ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি ছিলেন একজন ইংরেজ ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও লিবারেটো রচয়িতা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ব্রিটিশ সমাজ ও শ্রেণিবৈষম্য, ভণ্ডামি এবং লিঙ্গ ও সমকামিতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য ফরস্টারের শ্লেষাত্মক ও সুসংবদ্ধ উপন্যাসগুলি সুপ্রসিদ্ধ। ফরস্টারের রচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমসাময়িক সমাজের বাধার তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিকল্প অনুসন্ধানই বেশি করে প্রদর্শিত করেছে। ‘হোয়াট আই বিলিভ’ গদ্যরচনাতেও তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণটি ফুটে উঠেছে। ফরস্টারের দুটি বহুখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ ও ‘হাওয়ার্ডস এন্ড‘ অবাস্তব শ্রেণিবৈষম্যের দিকটিকে তুলে ধরেছে।

ই.এম. ফরস্টারের ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া‘র সমগ্র উপন্যাস জুড়ে বন্ধুত্বের সংকট ধ্বনিত হয়েছে। ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলতে থাকে নোবেলটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শাসক ও শাসিতের মধ্যে সংঘাত বিদ্যমান সর্বত্র। উপন্যাসের শুরুর দিকে মেজর ক্যালেন্ডার ডা. আজিজকে সাক্ষাত করতে বললে আজিজের দেরি হওয়ায় সে চলে যায়। ক্যালেন্ডারদের মহিলারা আজিজের টোঙ্গা নিয়ে যায়, না জিগ্যেস করেই। আর পরিলক্ষিত হয় শাসিতদের কাছে শাসকদের জবাবদিহিতার প্রয়োজনহীনতার।

মসজিদে ডা. আজিজের সাথে দেখা হয় মিসেস মুরের। তাদের ভাল বোঝাপড়া, একে অপরের ধর্মের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রভাব উপন্যাসটির শেষ পর্যন্ত থাকে। মিসেস মুর মসজিদ থেকে নিজেদের অর্থাৎ ইংরেজদের ক্লাবে ফিরে যান। চন্দ্রপুরে ইংরেজদের ক্লাব শহরের শাসক ও শোষিতের বিভাজনকে তুলে ধরে। যেমন, উপন্যাসটিতে বলা হয়েছে “Indians are not allowed into the Chadrapore club even as guests“। চন্দ্রপুর বিভক্ত রয়েছে ইংরেজদের সিভিল স্টেশন এবং ভারতীয়দের নেটিভ সেকশনের দ্বারা। দুশ্রেণির মধ্যে বিরাজমান রয়েছে অনেক বড় গ্যাপ বা খাদ।

ফরস্টার বৈশ্বিক চিরন্তন শ্রেণি বিভাজনকে তুলে ধরেছেন তার এই উপন্যাসে। এই সমস্যা শুধু ভারতে নয় বরং জাতিগত সংঘাত আমরা লক্ষ করি বিশ্বের সর্বত্র। আফ্রিকান নিগ্রোদেরকে ইউরোপিয়ান শ্বেতরা শাসন ও শোষন করেছে শত শত বছর। কনরার্ডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ বা ডেরেক ওয়ালকটের ‘এ ফার ক্রাই ফরম আফ্রিকা‘য় শোষন ও বঞ্চনার একইরুপ দেখা যায়। স্থান, কাল ও জাতি ভিন্ন হলেও সর্বত্র যেন একই চিত্র। আর ফরস্টার তার ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া‘য় ভারতে ইংরেজ শাসনের এ সকলদিক যথার্থভাবে বর্ণনা করেছেন।

আমরা উপন্যাসটিতে জানতে পারি, মিসেস মুর এবং অ্যাডেলা কোয়েস্টেড ভারতে নতুন আগমন করেছন এবং তারা প্রকৃত বা রিয়াল ইন্ডিয়াকে জানার অভিলাষ পোষণ করেন। তাদের বাসনা পূর্ণ করতে ইংরেজরা আয়োজন করে ব্রিজ পার্টির। সেখানে ভারতীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আমন্ত্রিত হয়। ব্রিজ পার্টির উদ্দেশ্য ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে গ্যাপ দুর করা হলেও ইংরেজরা শাসিতদের সাথে কোন কথা না বলে অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। নবাব বাহাদুরসহ ভারতীয়রা চরম অপমানবোধ করে। ইংরেজরা বলে, “We are out here to do justice and keep the peace. We are not pleasant in India, and we don’t intend to be pleasant. We have something more important to do“. ব্যর্থ হয় ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থাপনের একটি বিরাট সুযোগ। যদিও মিসেস মুর ও অ্যাডেলা কোয়েস্টেড ভারতীয়দের সাথে মিষ্টি ব্যবহার করেন। মনুষ্য সমাজে সব মানুষ যে বিবেকহীন পাশবিক নয়, সেটিও লক্ষ করা যায় এ উপন্যাসে। মিসেস মুর, অ্যাডেলা ও ফিল্ডিং ইংরেজদের কুৎসিত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এ ধরনের কিছু আলোকিত মানুষের কারণেই পৃথিবী নামক গ্রহটি তার উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পেরেছে। মানুষে মানুষে শান্তি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তাই এখনো বিরাজমান।

চন্দ্রপুর সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ সিরিল ফিল্ডিং-এর সাথে আজিজের সম্পর্ক বেশ ভাল। আজিজ তাকে তার মৃত স্ত্রীর ছবি পর্যন্ত দেখায় কোনরূপ পর্দাপ্রথার তোয়াক্কা না করেই। এটি তাদের বন্ধুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সরকার, আইন ও আদালত ইত্যাদি কি নেই এই উপন্যাসে। পাঠক হৃদয়কে নাড়া দিতে সব কিছুর যেন এক অপূর্ব সমাহার। উপন্যাসের একপর্যায়ে আজিজের সাথে অ্যাডেলার কথা হয় মুঘল শাসন নিয়ে। অ্যাডেলা মত ব্যক্ত করে যে, সম্রাট আকবর মহান শাসক ছিলেন। আজিজ সম্রাট বাবরের প্রশংসা করলেও সম্রাট আকবরের বহু ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত এক ধর্ম ‘ধর্মে ইলাহি‘র বিরোধিতা করে। লেখক তার এ রচনায় এদেশের বিশ্বাস ও পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থাকেও তুলে এনেছেন সাবলীলভাবে।

মসজিদ পর্বে কিছু সুখকর বিষয় দেখা গেলেও তা মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়ে গুহা পর্বে এসে। ডা. আজিজ মারাবার গুহায় পিকনিকের আয়োজন করে। এতে যোগ দেয় মিসেস মুর ও অ্যাডেলা কোয়েস্টেডসহ অনেকে। অ্যাডেলা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মিস ডেরেকের সাথে শহরে ফিরে আসলে তাকে হসপিটালাইজ করা হয়। ডা. আজিজকে গ্রেপ্তার করা হয় অ্যাডেলাকে হেনস্তা করার অভিযোগে। ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে এটি বিদ্যমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। ব্রিটিশরা মনে করে যে, শ্যাম বর্ণের সকল লোকেরই শ্বেত বর্ণের নারীদের প্রতি যৌন লালসা থাকে। এখানে বর্ণবৈষম্য আলোচিত হয়েছে যা শুধুমাত্র একটি জাতীয়ই নয় বরং বৈশ্বিক সমস্যা। ডা. আজিজ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এবং স্বদেশীয়রা তার পক্ষে মাঠে নামে। অপরদিকে ইংরেজরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় যে, যেকোন মূল্যে ডা. আজিজের শাস্তি নিশ্চিত করার। শাসকদের ক্ষমতার দাপট সম্পর্কে বর্ণনাকারী বলেন, “At Chandrapore, the Turtons were litte gods….“। ডা. আজিজের বিচারের মাধ্যমে তারা ভারতীয়দের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার তীব্র উত্তাপ ছড়ায়। যেকোন সময় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

হোমারের দ্যা ইলিয়াডে প্যারিসের হেলেনকে অপহরণের কারণ দেখিয়ে গ্রীকরা ট্রয় নগরী ধ্বংস করে। প্রাচীন কালের এই মহা যুদ্ধের কারণ প্যারিস ও হেলেন হলেও মূল কারণ ছিল ভিন্ন। সেখানে বৈশ্বিক রাজনীতিই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। প্যারিস ও হেলেন ছিল গ্রীকদের অভিলাষ পূরণের অজুহাত মাত্র। অনুরূপভাবে ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া‘র অ্যাডেলাকে কেন্দ্র করে আজিজ তথা ভারতীয়দদের একটি চরম শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ইংরেজরা। এ ধরনের কপটতা পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে। ফরস্টার এ বিষয় তুলে ধরতে তার দক্ষ হাতের ছাপ রেখেছেন।

আজিজের পক্ষে কলকাতা থেকে আইনজীবী ব্যারিস্টার অমিত রাওকে আনা হয় এবং নিরাপক্ষ বিচারের জন্য স্বদেশী বিচারক হিসেবে মি. দাসকে নিয়োগে বাধ্য করা হয়। আদালতে অ্যাডেলার সাক্ষ্য আজিজের পক্ষে গেলে আজিজ নির্দোষ প্রমাণিত হয় ও মুক্তি পায়। ইংরেজদের সাথে স্বদেশীয়দের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আর কোন অবকাশ থাকে না। যদিও ফিল্ডিং তার ক্লাব থেকে পদত্যাগ করে এবং আজিজের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সুতরাং আজিজের সাথে ফিল্ডিং এর বন্ধুত্ব তখনো অটুট থাকে। এ পর্যায়ে এসে মনে হয় ফিল্ডিং যেন যীশুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি আজিজের উদ্ধার কাজে নেমেছেন। স্বজাতির কাছে বিবেচিত হয়েছেন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। তিনি তার ক্লাবের পদ থেকে পদত্যাগ করে আজিজের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।

ডা. আজিজের বিরুদ্ধে মামলা ও তার সম্মান নষ্ট করায় অ্যাডেলাকে বড় অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়। ফিল্ডিং অ্যাডেলার জরিমানা মওকুফ করার জন্য আজিজকে অনুরোধ করায় আজিজ তা রক্ষা করলেও তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অর্থ নিয়ে বন্ধুত্বের মধ্যে চিরন্তন বিভেদ লেখক এখানে তুলে এনেছেন। আজিজ ফিল্ডিংকে ভুল বোঝে যে, ফিল্ডিং অ্যাডেলাকে বিয়ে করে তার মওকুফ করা অর্থের মালিক হবে। ফিল্ডিং আর অ্যাডেলা ইংল্যান্ড চলে যায়। পরবর্তিতে আজিজ ফিল্ডিংএর কোন চিঠির উত্তর দেয় না। এখানে তাদের বন্ধুত্বের অবসান ঘটে। সংঘাত ও সংকটের মধ্যদিয়ে ভারতীয়দের সাথে ইংরেজদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের সব লক্ষণ বা সম্ভাবনা গুহা পর্বে এসে দূরীভূত হয় এবং অন্ধকারে হারিয়ে যায়। গুহার ভিতরের অন্ধকার যেন মানব জীবনকে আচ্ছন্ন করে।

মন্দির পর্বে এসে আমরা দেখতে পাই যে, ডা. আজিজ ও গড়বোলে মৌতে চাকুরী করে। ফিল্ডিং শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে মৌতে স্ত্রী ও শালকসহ আগমন করে। ডা. আজিজ ও ফিল্ডিং তার পরিবারসহ শ্রী কৃষ্ণের জন্মোৎসবে যোগ দেয় এবং তাদের উভয়ের নৌকা ডুবি ঘটে। ডা. আজিজ ও ফিল্ডিং গঙ্গাজলে ধৌত হওয়ায় তাদের সকল গ্লানি ও কদর্য দূরীভূত হয়। আজিজ জানতে পারে যে ফিল্ডিং অ্যাডেলাকে নয়, স্টেলাকে বিয়ে করেছে। ফিল্ডিং আজিজের নিকট নতুনভাবে বন্ধুত্বের প্রস্তাব করলে আজিজ তা নাকচ করে দেয়। লাস্ট রাইডে তাদের ঘোড়া দু’টোও সে প্রস্তাব অস্বীকার করে, একইভাবে অস্বীকার করে আকাশ, বাতাস ও প্রকৃতি। তারা বলে “No, Not there”. শাসক ও শাসিতের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন ব্যর্থ হয়। এমনকি ইংরেজদের ভারত শাসনের অবসান দৃষ্টিগোচর হয়। ফিল্ডিং আশংকা করে হয়ত জাপানিরা এদেশ শাসন করবে এবং অভিযোগ তোলে যে স্বদেশীরা বহুধাবিভক্ত। আজিজ সেসকল কথা নাকচ করে দেয় এবং স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজদেরকে ঘৃণা করার কথা জানিয়ে দেয়। ডা. আজিজ বলেন, “We may hate one another, but we hate you most“.(Chapter 37)

ই.এম. ফর্স্টার তার এ উপন্যাসে যথেষ্ট সার্থকতার পরিচয় দিলেও তিনি বিখ্যাত গবেষক এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম অনুসারে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। ওরিয়েন্টালিজম হল মানুষ তার নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে বা তার স্বজাতিকে সেরা ভাবে, আর অন্যকে ভাবে নীচ, হীন, অসভ্য কিংবা বর্বর। নিজেদেরকে উচু শ্রেণীর ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং অন্যদেরকে ‘আদারস ও গণ’ হিসেবে মনে করে। তারা অন্যদেরকে প্রিকন্সেপ্ট দ্বারা সাব্যস্ত করে। ই.এম. ফরস্টার তার এ উপন্যাসে যথেষ্ট নিরপেক্ষতার পরিচয় দিলেও তার বর্ণনার অনেকগুলো কথা উপনিবেশবাদ উত্তর পাঠকদেরকে সামান্য হলেও বিরক্ত করে। তিনি আজিজকে দেখেছেন উদার, আবেগপ্রবণ, উত্তেজিত, অতিরিক্ত বদান্য ও বিচলিত হিসেবে। ফিল্ডিংকে দেখিয়েছেন পারফেক্ট বা উপযুক্ত, বুদ্ধিমান, আলোকিত, রক্ষণশীল, ক্ষমাশীল এবং সাহায্যকারী হিসেবে। মিসেস মুরকে উপস্থাপন করেছেন মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে। আর গড়বোলেকে আধ্যাতিক ও অলস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ভারতীয়দের অলস, নোংরা ও হুজুগে হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইংরেজদের সিভিল স্টেশনকে সভ্য সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার আলোকিত ব্যক্তিত্ব ফিল্ডিংয়ের দ্বারা প্রশ্ন করিয়েছেন যে, ভারতীয়রা নিজেদের শাসন করতে পারবে কিনা, নাকি জাপানিদের ডেকে আনবে এবং আবারো অন্যদের দ্বারা শাসিত হবে। ফিল্ডিং বলেন, “India shall be a nation! No foreigners of any sort! Hindu and Muslem and Sikh and all shall be one! Hurrah!” যেভাবে ইউরোপিয়ানরা নন ইউরোপ তথা ইস্টদেরকে উপস্থাপন করে থাকে তা ই.এম. ফরস্টারের রচনায়ও দেখা যায়। জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেসে’ এভাবেই নেটিভদের দেখানো হয়েছিল যেটির কঠোর সমালোচনা করেন আফ্রিকান স্কলার চিনুয়া এচিভি। সামগ্রিক পর্যালোচনা শেষে বলা যায় ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’য় ই.এম. ফরস্টার তার সামান্য নেতিবাচকতা ছাড়া যথেষ্ট নিরাপেক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

ই.এম. ফরস্টার তার ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ উপন্যাসে মানুষে মানুষে সংঘাত, শত্রুতা, হিংসা, বিদ্বেষ, অসাম্য, বৈষম্যকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিনির্মাণে প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দেখিয়েছেন মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে, জাতি অন্যজাতির বিরুদ্ধে, সংস্কৃতি অন্যসংস্কৃতির বিরুদ্ধে কিভাবে ধ্বংশাত্মক কর্মকান্ড চালিয়ে যায়। শাসক ও শাসিতের মধ্যে বন্ধুত্ব হওয়া কঠিন হলেও উভয় পক্ষের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলে সেটি সম্ভব বলেই মনে করেন লেখক। ভারতীয়দের সাথে ইংরেজদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতাকেই ইংরেজদের এদেশ থেকে বিদায়ের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ই.এম. ফরস্টার। বাস্তব জীবনে বন্ধুত্বতের প্রয়োজনীয়তা অনেক। তাই ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়‘ কথাটি ফলপ্রসূ বলে মনে হয়। শেষ কথায় বলা যায় বন্ধুত্বই মানুষের মাঝে দূরত্ব ঘুচিয়ে নিকটবর্তী করতে পারে এবং মনুষ্য জগতে বয়ে আনতে পারে অনাবিল সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

মোঃ রহমাতুল্লাহ
ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

The post অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া: ব্রিটিশ ভারতে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের স্বরূপ appeared first on Bangladesh Study Forum.

ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শন

$
0
0

ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) বর্তমান তিউনিসিয়ার একজন সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্তা ছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত বই ‘আল-মুকাদ্দিমা’র শুরুতে বলেন, “ইতিহাস এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বিশ্বের সকল জাতি ও গোত্রের নিকট সমাদৃত। সাধারণ মানুষগুলো তা জানতে আগ্রহী এবং রাষ্ট্রপতি ও নেতৃস্থানীয়রা তাতে স্থান পেতে প্রতিযোগিতা করে”

ইতিহাসের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে,কিভাবে সমাজের পরিবর্তিত অবস্থা তাদের সম্পর্কের জালগুলোতে প্রভাব ফেলে। কিভাবে একটা গোত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং কিভাবে তার পতন ও বিকাশ হয়। কিভাবে অন্য সাম্রাজ্য এসে পুরাতনদের পতন ঘটায় এবং নব্য সাম্রাজ্যের বিস্তার করে।

ইবনে খালদুন ইতিহাসের দুটি দিক উল্লেখ করেন, ১.জাহেরী রূপ, ২.বাতেনি রূপ। জাহেরী রূপটা মূলত অতীতের রাজা-বাদশা, যুদ্ধ ও রাষ্ট্রের কাল্পনিক ও গল্পাশ্রিত বিবরণী। এতে অতীতের রাজা-বাদশার স্তুতি ও বিপক্ষ দলের কুৎসা রটনা, রাজাদের বংশ পরস্পরা, সংখ্যা ও সালের আধিক্য থাকে। এতে কোন ঘটনার পেছনে তার সম্ভাব্য সামাজিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণগুলোর উল্লেখ থাকে না।

ইতিহাসের জাহেরি রূপটা সাধারণ মানুষের বিনোদনের খোরাক। এই ইতিহাসগুলো রচিত হয় ক্ষমতাশীল শাসকের গৃহপালিত ইতিহাসবেত্তা দ্বারা। সব যুগের ক্ষমতাশীলরাই তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য গৃহপালিত কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, ইতিহাসবিদের লালন-পালন করেন। আর এর মধ্য দিয়েই সাধারণ মানুষের মনকে উদ্দেশ্যহীন ধোয়াটে মরুরে রেখে তাদের কাধেই ভর করে রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী করে জালেম শাসক!

অন্য দিকে বাতেনি রূপ হল ইতিহাসের অন্তর্নিহিত দিক। এ দিকটা উল্লেখ করতে গিয়ে খালদুন ইতিহাসকে দর্শনের একটা মূল শাখা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং জ্ঞান চর্চার ইতিহাসে ‘ইতিহাসের দর্শন’ নামক নতুন এক সাগরের সন্ধান দেন। পরবর্তীতে এই সাগর জলে স্নান করতে গিয়ে অনেক উপসাগর, নদী ও শাখা নদীর ধারা তৈরী করেন তারই বাতেনি ভাবশিষ্য ভিকু, হেগেল, মার্কস, ডারউইন, গীবন, ই বি টেইলর, স্পেনসার ও আরো অনেকে।

ইবনে খালদুন ইতিহাসের বাতেনি রূপকে জাহেরি রূপ অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক,গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত মনে করেন,এই ধারা আমাদের সমুখে অতীত ঘটনাবলীর কারণ, বিকাশ ও বিনাশের স্বরূপ উন্মোচন করে। ‘ইতিহাসের দর্শন’ এর মূল কাজ হল কোন ঘটনা কিংবা বিষয়কে ‘কিভাবে’ (How) ও ‘কেন’ (Why) দ্বারা প্রশ্ন করে তার মূলকে জানা। এরিস্টটল তার ‘অধিবিদ্যা'(Metaphysics) নামক বইতে যেভাবে কোন বিষয়ের পেছনে চারটি কারণ (উপাদানগত, আকারগত, কার্যকরী ও উদ্দেশ্যমূলক কারণ) উল্লেখ করেছেন ‘ইতিহাসের দর্শন’ অনেকটা তার কাছাকাছি।

ইবনে খালদুন ইতিহাসের সহীহ চর্চা পদ্ধতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে তার পূর্বেকার অনেক ইতিহাসবেত্তার ইতিহাস লিখন পদ্ধতির সমালোচনা করেন এবং ইতিহাস কিভাবে সত্য হতে বিচ্যুত হয়ে আধাঁরের আকর্ষণীয় মিথ্যা মোহের জালে বন্দী হয় তা স্পষ্ট করে দেখান।

খালদুন ইতিহাস রচনায় বেশী গুরুত্ব দেন ইতিহাস সম্পর্কিত নানা মুখী তথ্য-উপাত্ত এবং রচনাকারীর বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। যে দুটি গুণ ইতিহাস রচনাকারীকে মিথ্যার মোহনীয় আকর্ষণ অতিক্রম করে সত্যের মানজিলে মাকসুদে পৌছার পথ সুগম করে,তা হলো কান্ডজ্ঞান ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি।

কোন ঐতিহাসিক লব্ধ বিবরণকে মানবজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাষ্ট্রনীতির মৌলিক তাৎপর্য এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপাদানগত বৈচিত্র্য এবং অদৃশ্যমান ঘটনাকে দৃশ্যমান ঘটনার আলোকে ও অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মাপকাঠিতে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে ঘটনার সত্যতা যাচাই বাছাই করতে হয়। তা না করলে মিথ্যা কল্পনারসে ইতিহাস বিকৃত হতে বাধ্য। আর এরই ফাঁদে পা দিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ, কোরআনের অনেক তাফসীর কারক, নবী রসুলদের জীবনী লেখক।

ইবনে খালদুন তার বইয়ে পূর্বেকার ইতিহাসবিদ মাসউদী এবং ওয়াকেদীর গ্রন্থসমূহের আপত্তিকর বর্ণনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির উল্লেখ করেন। ইতিহাস বিকৃতির আমাদের সময়কার উদাহরণ হলো, ‘৭১’ নিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানী ইতিহাসবিদদের লেখা বই গুলো। তারা সবাই ঘটনার পূর্বোল্লিখিত পদ্ধতি ভুলে নিজস্ব পক্ষ নিয়ে, নিজেদের সুবিধামত চশমা চোখে লাগিয়ে ঘটনার বিররণ দিয়েছেন।

খালদুনের ভাষায় বললে ‘৪৭,’৫২ ও ‘৭১-এর ঘটনা সংবলিত ইতিহাসের বইগুলো বেশীরভাগই ইতিহাসের জাহেরি রূপ। এই ঘটনাগুলোর ‘বাতেনী রূপ’ ইতিহাস অতি নগন্যই লিখিত হয়েছে। তবে নতুন কেউ যদি এই ঘটনাগুলোর সহীহ ইতিহাস জানতে চায়, তাকে পূর্বোল্লিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করে দুই বিপরীত পক্ষের বক্তব্য এবং তৃতীয় পক্ষের বক্তব্য শুনতে হবে। সাথে সাথে নিজের ভেতর কাণ্ডজ্ঞান ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ ঘটাতে হবে। এতে করেই সত্যের স্বর্গীয় পরশ সম্ভব।

“ইতিহাসে কিভাবে মিথ্যাচারের আগমন ঘটে”:

১. ইতিহাস রচয়িতাদের একচোখা নীতি ও অন্ধ আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি।

২. ঘটনা বর্ণনাকারীর উপর রচয়িতার অন্ধ বিশ্বাস।

৩. ঘটনা ও বিবরণকারীর বিবরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতিহাস লেখকের উদাসীনতা।

৪.  অতীতের ঘটনাকে বর্তমানের দৃশ্যমান কোন ঘটনার সাথে মিলিয়ে দেখতে না পারার অজ্ঞতা।

৫. পূর্বানুমান থেকে ঘটনার ব্যাখ্যা করা।

৬. ক্ষমতা ও পদমর্যাদার অধিকারী লোকদের নৈকট্য লাভের জন্য প্রশংসা ও স্তুতি প্রয়োগ ঘটনার বিবরণকে অতিরঞ্জিত করে।

৭. মিথ্যা অনুপ্রবেশের অধিকতর ব্যাপক কারণ হল, মানব সভ্যতার অন্তর্গত বিভিন্ন ভৌগোলিক স্থানের প্রকৃতি সম্পর্কে ইতিহাস রচয়িতার অজ্ঞতা।কারণ, জগতে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনাই অন্যকোন ঘটনার প্রতিক্রিয়া কিংবা ফল।বস্তুজগতের সবকিছুই কার্য-কারণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল। রচয়িতা যদি জগতের এই আদিম রীতি সম্পর্কে ভাল জ্ঞান না রাখে, তাহলে সে সত্য-মিথ্যার ফারাক করতে অক্ষম হবে। এবং তার ইতিহাসের বিবরণীতে মিথ্যা সহজেই অনুপ্রবেশ করে।

৮. বর্ণনাকারীর সহীহ সূত্র তালাশ অপেক্ষা তার বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে মিথ্যাচার সত্যের উপর আধিপত্য করে।

খালদুনের ইতিহাস লিখন ও পঠন পদ্ধতির সাথে স্বরূপ তত্ত্ব (Phenomenology),নব- নির্মাণ (Deconstruction) ও সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতির গভীর মিল রয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাস গুলোর ত্রুটি বিচ্যুতি ধরে নতুন স্বচ্ছ রূপে সাজাতে পারি নিজেদের। আর এরই মধ্য দিয়ে হবে বাঙালি মুসলিম সমাজের নবজাগরণ।

তথ্য সূত্রঃ
Al-Mukaddimah-Ibn khaldun.
ইংরেজি ভাষান্তর-Franz Rosenthal.
বাংলা ভাষান্তর-গোলাম সামদানী কোরায়শী।

The post ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শন appeared first on Bangladesh Study Forum.

আমার পড়া সেরা ১০ টি বই

$
0
0

যে বইগুলো আমাদের মনে দাগ কাটে, ভাবনার দোয়ার খুলে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়, জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়; যে বইগুলো আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখে সেগুলোকে আমরা জীবন পাল্টে দেয়া বই বা সেরা বই  বলতে পারি। জীবন পাল্টে দেয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়া এরকম বইয়ের তালিকা করতে বলা হলে এই বছরে যে বইগুলোর নাম নেবো আগামী একছর বা দশবছর পর দেখা যাবে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে, অনেক যোগ-বিয়োগ হবে। একই কথা সাজে পেছনের বছরগুলোর বেলাতেও। স্কুলজীবনে যে ধরণের বই ভালো লেগেছে, দাগ কেটেছে; কলেজে দেখা গেছে অন্য ধরণের বই ভালো লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনগুলোতে যে বইগুলো ভালো লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ চুকিয়ে হয়তো সেগুলো আর ভালো লাগছেনা বা ভালো লাগার তালিকায় নতুন কিছু যোগ হয়েছে।

একজন সচল ও সক্রিয় পাঠকের পছন্দের তালিকা সবসময় বিকাশমান। এটাও সত্য প্রত্যেক পাঠকের জীবনে এমন কিছু বই থাকে যেগুলো প্রিয়, প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকায় সারাজীবন থেকে যায়।

আমার তালিকা করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মহাগ্রন্থগুলো রাখিনি। তবে ভূমিকাতে তাদের নাম নিয়ে রাখলাম। পবিত্র কুরআন, পবিত্র বাইবেল, পবিত্র গীতা আমার পড়া তিনটি অসাধারণ গ্রন্থ।  প্রত্যেকটিই বহুবার পড়া।  শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।  অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোও ঠিক এমন প্রভাবশালী হবে বলেই মনে করি।  প্রত্যেকটি ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলো একে একে পড়ে শেষ করার আশা রাখি।

চলেন, পড়ার মতো, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়ার মতো, জীবন পাল্টে দেয়ার মতো দশটি বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই।

১. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ-সেনেকা

রোমান দার্শনিক লুকিউস আন্নাইউস সেনেকার লেখা ‘জীবন এতো ছোট কেন’ আমার পড়া সবচেয়ে সেরা বইয়ের একটি।  ল্যাটিনে ‘দ্য ব্রেভিতাতে ভিতায়ে’ কে ইংরেজিতে ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ করা হয়েছে।  বাংলা করার সময় প্রথমদিকে আমি এটাকে ভাবার্থে ‘জীবন ছোট নয়’ হিসেবে চালিয়েছে।  পরবর্তীতে ল্যাটিনে দক্ষতা রয়েছে এমন এক পণ্ডিতবরের সহায়তায় ‘জীবন এতো ছোট কেন’ ব্যবহার করা শুরু করেছি।  নাম যেভাবেই দেই না কেন দুটোতেই বইটির ভাব সুষ্পষ্ট হয়।

বইটির প্রথমদিকেই জীবন এতো ছোট কেন সেটি নিয়ে অনেকের প্রশ্নের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে।  বইটি শেষ করলে আমরা উত্তর পাবো জীবন ছোট নয়।  তবে এর সাথে কিছু ‘যদি, কিন্তু’ রয়েছে।  সেগুলো অনুসন্ধানের জন্যই বইটি পড়তে হবে।  শুধু পড়লেই হবেনা।  সেনেকা যে পথ বাতলে দিয়েছেন সেই মতে কাজ না করলে ফল লাভ হবে না।  এই স্বল্পমেয়াদী জীবনকে যদি ফলবান, মূল্যবান করতে চাই তাহলে সময়কে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে সে বিষয়ে কার্যকরী সদুপদেশ নিয়ে হাজির সেনেকা।

বইটি আকারে ছোট কিন্তু গুরুত্বে অনেক ভারী, তাই এক পাঠে চলবে না। সবসময় কাছে রাখার মতো একটি বই। বইটিতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এসেছে। যেমন অনেকেই এই প্রশ্ন করে মানুষ কেন এতো অল্প দিন বাঁচে কেন, মানুষের জীবন এতো ছোট কেন?

অনেকের মাথায় এই প্রশ্ন জাগে-কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, অনুজীব, ভাইরাস আছে যা মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় বাঁচে কিন্তু মানুষ কেন এতো অল্প সময় বাঁচে? মানুষ যেখানে কতো বড় বড় কাজ করতে পারে সেখানে কিছু প্রাণীকে মানুষের চেয়ে পাঁচগুণ, দশগুণ বেশি সময় দিয়ে রাখা হয়েছে যাদের ভোজন-আহার ও বাচ্চা পয়দা ছাড়া আপাত আর কোন কাজ নেই।

মানুষকে কম সময় দেয়া হয়েছে এটি স্বীকার করতে সেনেকা নারাজ। তিনি মনে করেন, আমাদেরকে অল্প সময় দেওয়া হয়নি বরং আমরা আমাদের সময়ের বড় অংশটাই অপচয় করি। আমাদের সময়ের পুরোটা যদি ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে সে সময়ের মধ্যেই অনেক বড় বড় কাজ করাই সম্ভব।  কিন্তু এটা যদি হেলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়, শুধু ভোগে বিলিয়ে দেওয়া হয়, কোন মহান উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো না হয় তাহলে দেখা যাবে সময়টা কখন যে হাওয়ায় উড়ে গেছে, একেবারে টের পাওয়ার আগেই।

বেশিরভাগ মানুষই কিভাবে অন্যের জন্য বাঁচে, অন্যের জীবন যাপন করে এবং সবচেয়ে কম কাছের থেকে যায় নিজের কাছে, এর উপলব্ধি হবে বইটি পড়ে। মানুষ কেমন অদ্ভূতরে আচরণ করে, এমনকি নিজের সঙ্গেও! তারা তাদের মালিকানায় থাকা জায়গা-জমির এক ফুট ও যদি অন্য কেউ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে কেমনে ক্ষেপে যায়, তেড়ে আসে, এমনকি জান কুরবান করে ফেলে বা অন্যেরটা নিয়ে ফেলে!  অথচ কোন মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যদি থাকে সেটা হলো সময়। আমরা সেই মূল্যবান সম্পদ সময়টিতে কিভাবে বিভিন্ন মানুষকে ভাগ বসিয়ে দিতে দেই? এবং জায়গা-জমি, অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে বড় কিপটা হলেও সময় সম্পদ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বদান্য।  যাকে তাকে মালিকানা দিয়ে দেই এই মহামূল্যবান সময় বা সময়ের বড় অংশটুকুর।  সেনেকার মতে এটা এমন বড় ডাকাতি যেটা মালিক টেরই পায় না।

আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার।  সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়।

আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার।  সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়।  তাই আমার মতে বই মানুষের জন্য সেরা সফটওয়ার।  আর একেকটা সেরা বই পড়া হচ্ছে একেকটা সফটওয়ার ইন্সটল করা; তার মানে জগতকে একেকবার একেকটি দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা অর্জন করা।

সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ আমার কাছে তেমন একটি বই।  যখন মনে হয় অহেতুক সময় অপচয় করছি, যখন মনে হয় আমি আমার নিজের কাছে কমিটমেন্টের সাথে প্রতারণা করছি, আমার মনের গহীন কোণে হতাশার চাষবাস করছি তখনই এমন কিছু সফটওয়ারের সাহায্য নেই।  এগুলো ইনস্টল করার মাধ্যমে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি।

আমাদের সময়ের পুরোটা যদি ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে সে সময়ের মধ্যেই অনেক বড় বড় কাজ করা সম্ভব।

আমি বইটি পড়ে নিজে উপকৃত হয়েছি।  সময় ও নিজের জীবনের মূল্য নিয়ে সচেতন হয়েছি।  নিজের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার উপর আত্মবিশ্বাস মজবুত করেছি। সেনেকার মূল বয়ানটার সঙ্গে একেবারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে স্বীকার করি-জীবন ছোট নয়, যদি সেটাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়।

একই সঙ্গে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনের কথা এ জায়গায় স্মর্তব্য: ‘আপনি কী কী করতে অক্ষম সেগুলো নয় বরং আপনি যা যা করতে সক্ষম তা-ই যদি ঠিকঠাকভাবে করেন তাহলে আপনি নিজেই নিজেকে বিস্মিত করবেন।’

আপনি কী কী করতে অক্ষম সেগুলো নয় বরং আপনি যা যা করতে সক্ষম তা-ই যদি ঠিকঠাকভাবে করেন তাহলে আপনি নিজেই নিজেকে বিস্মিত করবেন।

 

২. দ্য স্টোরি অব ফিলসফি-উইল ডুরান্ট

কিছু কিছু বই আছে যেগুলো মনে হবে যেন এক সমৃদ্ধ খনি। সেখানে মেলে নানা মণি- মুক্তা, মূল্যবান সম্পদ। সেসব সম্পদ আবার কিপটে লোকের মতো সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখতে হয় না। এ সম্পদ এমন যা বিলিয়ে দিলে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

উইল ডুরান্ট তার ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’তে এমন মহামূল্যবান সম্পদের সমারোহ ঘটিয়েছেন। পাশ্চাত্য দর্শনের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস এই ৭০০ পৃষ্ঠার বইয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন।

এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যেকার বিভিন্ন দার্শনিকদের জীবন ও প্রধান দার্শনিক কর্মকাণ্ডগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যেকোন স্তরের পাঠক দর্শনের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে, আড়াই হাজার বছরের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে পরিচিত হতে পরম বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে পারে ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’কে।

উইল ডুরান্টের বড় যে শক্তির জায়গা সেটি হলো তার সমৃদ্ধ কিন্তু সহজবোধ্য ভাষা। উইল ডুরান্ট স্বয়ং নিজে ইতিহাসের দর্শনের বড়ো পুরোহিতদের একজন। এজন্য দর্শনের অগ্রযাত্রার কোন পর্বটাতে আলো ফেলতে হবে, দর্শনের কোন রথি মহারথিকে জনসমক্ষে পেশ করতে হবে তা তিনি বেশ ভালো করেই জানেন। এজন্য বইটির আঙ্গিক, বুনন ও বিস্তারে পরিপক্বতা ও নিপুণতার ছাপ স্পষ্ট করে প্রতিভাত হয়।

তার লেখা প্রতিটি ইতিহাস গ্রন্থই একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতার সন্ধান দেয়!

দর্শনের বিস্তৃত দুনিয়ায় প্রবেশ ও দখল করতে আগ্রহীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ও কার্যকর একটি দরজা হতে পারে উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’।

 

৩. দ্য সেয়িংস অব কনফুসিয়াস

কনফুসিয়াস ছিলেন একই সাথে একজন রাজনীতিবিদ, কবি, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং সাধু। একই সঙ্গে অনেক কিছুর মিশেল।

শিক্ষার এই নিত্য নিম্নমুখী যাত্রার প্রাক্কালে দাড়িয়ে অতীতে ফিরে দেখতে চাচ্ছিলাম এমন শিক্ষক কি ছিলেন যাদেরকে ছাত্ররা মন থেকে সম্মান করতো? যাদের জ্ঞান সমকাল থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী বিভিন্ন যুগে মানুষকে দিশা দিতো? এই অনুসন্ধান চালিয়ে দেখলাম মানবজাতির ইতিহাসে সেরা কয়েকজন শিক্ষকের তালিকাতে বেশ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত কনফুসিয়াসের নাম।

চীনে কয়েক হাজার বছর ধরে অনেক সম্মানিত এবং আদৃত মহামানব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছেন তিনি, বর্তমানে যার নাম বিশ্বের আনাচে কানাচেও উচ্চারিত হচ্ছে।  চীনের তিন মহারথী লাও জু, সান জু আর কনফুসিয়াসের শিক্ষা সবসময় আলো জাগানিয়া।

The Sayings of Confucius, Introduction and Notes by Lionel Giles

কনফুসিয়াসের শিক্ষার একটা বড় দিক হচ্ছে এটা একেবারে পরিবার থেকে শুরু করার কথা বলেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসংহত ও সুন্দর সম্পর্ক থাকলে সবচেয়ে বড় পরিবার যে রাষ্ট্র সেখানেও সুন্দর সম্পর্ক নিশ্চিত হয়। কারণ রাষ্ট্রও তো একটি বৃহৎ পরিবার।  ছোট্ট পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আমাদের বৃহৎ পরিবারে খুবই কাজের হিসেবে ঠেকে।

কনফুসিয়াসের মতে-‘আমরা তিনটি উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি: প্রথমত, গভীর চিন্তা বা অনুধ্যানের মাধ্যমে যেটা মহত্তম উপায়; দ্বিতীয় যে উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি সেটা হলো অনুকরণ, যেটা সহজতম; আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেটা সবচেয়ে তেতোময়।’ (p39-40, The Sayings of Confucius, Introduction and Notes by Lionel Giles, E. P. BUTTON AND COMPANY, NEW YORK, 1910)

আমরা তিনটি উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি: প্রথমত, গভীর চিন্তা বা অনুধ্যানের মাধ্যমে যেটা মহত্তম উপায়; দ্বিতীয় যে উপায়ে প্রজ্ঞা লাভ করি সেটা হলো অনুকরণ, যেটা সহজতম; আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যেটা সবচেয়ে তেতোময়।

শিশু প্রথম বড় শিক্ষাটা পায় তার পরিবার থেকে। সেখানে বাবা-মার আচার আচরণ শিশুর জীবনে প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখে। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর মন-মগজ-মনন ও চরিত্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।  শিক্ষকদেরকে অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা।  এজন্য শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে খুব সতর্কভাবে নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। কনফুসিয়াস বলেন ‘পচা কাঠে নকশাঁ করা যায় না’। এজন্য নষ্ট শিক্ষক, নষ্ট শিক্ষা কাঠামো থেকে বড় মানুষ, ভালো মানুষ বের হওয়া অনেক কঠিন।

নিজ জন্মভূমি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ফিরে খুঁজছিলেন সেই দার্শনিক সম্রাটকে। এ যেন প্লাতোর ‘ফিলসফার কিং’ খোঁজার প্রচেষ্টার সাথে তুল্য, বা চাণক্যের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে অখন্ড ভারতের অধিপতি খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্খা।

‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং সকল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনো। তাহলে জনগণ সন্তুষ্ট হবে। আর অপরাধীদেরকে লালন করো এবং ভালো মানুষদেরকে বিতাড়িত করো তাহলে অসন্তুষ্ট হবে’।

এক শাসক কনফুসিয়াসের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন: কি কাজ করলে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখা যায়? কনফুসিয়াসের উত্তর ছিল:

‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং সকল অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনো। তাহলে জনগণ সন্তুষ্ট হবে। আর অপরাধীদেরকে লালন করো এবং ভালো মানুষদেরকে বিতাড়িত করো তাহলে অসন্তুষ্ট হবে’।

একটা দেশের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার সাথে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সে দেশের কৃষ্টি কালচার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।  ভালো সরকার ব্যবস্থার জন্য এ সবকটি উপাদান একসাথে কাজ করতে হবে।  জু কুং নামে এক শিষ্য কনফুসিয়াসকে জিজ্ঞেস করেছিল- ‘ভালো সরকার কেমন?’ এর উত্তরে কনফুসিয়াস বলেন: ‘জনগণের পর্যাপ্ত অন্ন সংস্থান করলে,  দেশের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য মজুদ রাখলে এবং দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলে তাকে ভালো সরকার বলা যাবে। এখন এ তিনটি জিনিসের মধ্যে যদি একটিকে ত্যাগ করতে হয় তাহলে প্রথমে সৈন্য-সামন্তকে ত্যাগ করতে হবে। তারপর বাকি দুটোর মধ্যেও যদি একটিকে ত্যাগ করতে বলা হয় তাহলে সেটা হবে অন্ন। কারণ কোন না কোন সময় মানুষকে তো মরতে হবেই। কিন্তু জনগণের আস্থা ছাড়া কোন সরকারই টিকে থাকতে পারে না।’

কি অসাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক শিক্ষা কনফুসিয়াসের।  তার কথাগুলো আমাদের জন্য কতই না প্রাসঙ্গিক।

 

৪. অনুস্মৃতি-পাবলো নেরুদা

পাবলো নেরুদার জীবন পাঠ করে মনে হলো যেন এক মহাসমুদ্রের মত জীবনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতরূপে অসংখ্য নদীর সম্মীলন যেন তার বিশাল সমুদ্রস্বরূপ জীবন। কত তীড়ে তরী ভিড়িয়েছেন মহান এ কবি। তার পুরো জীবনটাই যেন ক্লাসিকাল সংগীতের মত। বিভিন্ন সুর, তাল লয়ের সম্মীলন। একজন কবি বড় হয়ে উঠেন তার বড় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। কবিদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হয় ঈগলের মত। অনেক দূর থেকে অতি সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম জিনিস দেখার ক্ষমতা আছে ঈগলের। কবিদেরকে মানবের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার এমনতর প্রস্তুতি থাকতে হয়।

কবিরা কেমন এ নিয়ে শার্ল বোদলেয়ার যাকে আর্তোর র‌্যাবোঁ ‘কবি সম্রাট’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন একটি আকর্ষণীয় কথা বলেছেন। কথাটা সরলভাবে বললে এমন দাড়ায় কবিদের ডানা এত বিস্তৃত যে তারা মাটিতে পা রাখতে পারেন না। অসীম আকাশেই কবিদের বসবাস!

কবিদেরকে বুঝাতে গ্রীক শব্দ Vates (ভাতেস)ব্যবহৃত হয়। খুব মজার ব্যাপার হলো প্রফেট এবং পোয়েট এ দুটো বুঝাতেই গ্রীকে এই একটি শব্দই ব্যবহৃত হতো। মানে পরিষ্কার কবি ও নবীকে তারা একই গোত্রের মনে করতো।

পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা পড়ে মনে হচ্ছিল তিনি যেন শার্ল বোদলেয়ারের সেই ঈগল পাখির মতো বিশাল ডানা মেলে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়েছেন আর জীবন থেকে দুহাত শুধু নয় চারহাত ভরে অভিজ্ঞতা নিয়েছেন।  এই বিশাল ভবঘুরে সারা বিশ্বকে নিজের ঘর আর আসমানকে সামিয়ানা করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। একজীবনে এত দেশ, এত মানুষের সঙ্গ, এত মানুষের সাথে বন্ধুতা, শত্রুতা, এত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা পাওয়া একজনের পক্ষে কিভাবে সম্ভব?

আমার পড়াশুনার অনেকগুলো কারণের মধ্যে যে কারণগুলোকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রাখি সেটা হলো:

প্রথমত, আমি নিজকে গড়ার জন্য পড়ি।

দ্বিতীয়ত, চলমান সংকটে পথ বা জীবনের রথ চালানোর জন্য অনুপ্রেরণা খুঁজি

জানার জন্য, বুঝার জন্য, আশ্রয়ের জন্য, বিনোদনের জন্য, সময়ের প্রয়োজনে পড়া তো আছেই। তবে আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে আমি সাধারণত প্রথমে এই উত্তরটিই দেই যে আমি পড়ি ‘টু শেইপ মাইসেল্ফ আপ’। দ্বিতীয়ত খুব আনন্দের মুহূর্তে বা কষ্টের মুহূর্তেও বই আমার খুব কাছের বন্ধু।

মোবাইলে কথা বলার জন্য যেভাবে রিচার্জ করতে হয় তেমনি জীবনকে সামনে নিয়ে যেতে হলে ভালো অনুপ্রেরণা লাগে।  এ অনুপ্রেরণা পেতে হলে আমাদেরকে কিছু মহান জীবনের কাছে যেতে হয়, তাদের ছায়ায় কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করতে হয়।  বই হচ্ছে তাদের কাছে পৌছার সবচেয়ে ভালো দরজা।

মোবাইলে কথা বলার জন্য যেভাবে রিচার্জ করতে হয় তেমনি জীবনকে সামনে নিয়ে যেতে হলে ভালো অনুপ্রেরণা লাগে।  এ অনুপ্রেরণা পেতে হলে আমাদেরকে কিছু মহান জীবনের কাছে যেতে হয়, তাদের ছায়ায় কিছুদিন হাঁটাহাঁটি করতে হয়।  বই হচ্ছে তাদের কাছে পৌছার সবচেয়ে ভালো দরজা। আর সেটা যদি হয় ওই মহান লেখক বা কবির নিজের লেখা তাহলে তো কথাই নেই। পাবলো নেরুদার ‘অনুস্মৃতি’ পড়ে রিচার্জ হয়েছি এটা বলতে পারি নির্দ্বিধায়।

বইটি মূলত স্পেনিশ ভাষায় লিখিত হয়েছে।  চিলিতে জন্ম নেয়া নেরুদার এ আত্মজৈবনিক লেখাটির মূল নাম স্পেনিশে ‘Confiesco que he vivido: Memories’ এর বাংলা ‘মর্মানুবাদ’ করেছেন ভবানীপ্রসাদ দত্ত। ‘অনুস্মৃতি’ নামে বইটি কলকাতায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে।  বাংলাদেশে একুশে পাবলিকেশন্স এটা পুন:প্রকাশ করে ২০০৪ সালে।

নেরুদা ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলিতে জন্মগ্রহণ করলেও সারা বিশ্বে রয়েছে তার অধিকার এবং তার উপরেও রয়েছে বিশ্ববাসীর অধিকার। এজন্য আমরা দেখতে পাই তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় কয়েকটি দেশ তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল।  তবে এর বিপরীত অভিজ্ঞতাটাই বেশি।  জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতাসীনদের দাবড়ানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।  তার মাথা ও জীবনের মূল্য ধরে রেখেছিল চিলির স্বৈরশাসকেরা।  দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য স্বৈরশাসকেরাও তাকে আশ্রয় দেয়নি। এজন্য কখনো প্যারিসে, কখনো ইতালি বা স্পেনে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বড় একটা সময়। সারা বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের ছিলেন তিনি আত্মার আত্মীয়।  এজন্য খুব সহজেই তাদের সাথে মিশে যেতে পারতেন এবং তাদের একজন হয়ে যেতেন। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী প্যারিস রিভিয়্যুতে এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে নেরুদা বলেছিলেন,

“আমি একজন চিলিয়ান।  দশকের পর দশক আমি দেখেছি কিভাবে এ দেশের মানুষগুলো দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।  আমিও দেশের অংশ হিসেবে তাদের কষ্ট-সুখের ভাগিদার হয়েছি।  আমি তাদের কাছে অতিথি নই। আমি এই জনগণ থেকেই উঠে এসেছি এবং আমি তাদেরই অংশ। আমি একটি শ্রমজীবি পরিবার থেকে উঠে এসেছি…আমি ক্ষমতাসীনদের মতন নই। আমার পেশা এবং দায়িত্ব হচ্ছে চিলিয়ান জনগণকে সেবা করা। এবং আমি আমার কাজ এবং কবিতার মাধ্যমে সেটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি তাদের গান গেয়ে, তাদের পক্ষ নিয়েই বেঁচেছি।”

সত্যিই তিনি ছিলেন শ্রমজীবি, কৃষক, মুটের অতি আপনজন। তাদের জীবন সংগ্রামের কথা তার লেখাতে উঠে এসেছে নিঁখুতভাবে। সাধারণ মানুষও তাকে ভালোবেসেছে কাছের বন্ধু হিসেবে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে। তবে তিনি শাসকগোষ্ঠির কাছে বিশেষ করে স্বৈরশাসকদের কাছে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তার কবিতা, তার শব্দঝঙ্কার অনেক স্বৈরশাসকের তখত কাপিয়ে দিতো। এজন্য তাকে আটক বা হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতো স্বৈরশাসকদের সেনারা। এজন্য বিভিন্ন ছদ্মনাম, ছদ্মবেশ এবং সাধারণ মানুষদের ভীড়ে হারিয়ে গিয়েই নিজেকে রক্ষা করতেন নেরুদা।

প্রথম জীবনে অবশ্য চিলির বাণিজ্যদূত হিসেবে কাজ করেছেন সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও মোহিকার মত দেশগুলোতে। ১৯২৮ এর দিকে এই ভারতবর্ষেও বেশ কিছুদিন ছিলেন এবং গান্ধী, নেহরুসহ অনেকের সাথেই পরিচিত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাতেও অবস্থান করেছিলেন নেরুদা। এ সব মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি নেরুদা আমাদেরও আত্মীয় এবং তার গড়ে উঠার পেছনে এই ভারতীয় উপমহাদেশও ভূমিকা রেখেছে।

 

৫. চাণক্যনীতি-চাণক্য

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই যে এক শক্তিশালী দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন সেটা অনেকেই ভুলে যাই বা অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যাই। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচিত হলে আমরা যে সমৃদ্ধ হবো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।  পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনা থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত মানুষের সম্ভাব্য যতগুলো দিক আছে তার প্রতিটির উপরই আলো ফেলেছেন এবং প্রাজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন।  চাণক্যের সমরবিদ্যা চৈনিক সমরবিদ সান জুর তুলনায় কোন অংশে কম নয়। সান জুর মতো চাণক্যের বেলাতেও বলা যায় ‘তুমি যদি চাণক্যের পরামর্শ শুনো কোন ক্ষেত্রে পরাজিত হবে না আর যদি তার পরামর্শের অন্যথা করো তাহলে তোমার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

চাণক্যের অনেক কথায় পাঠক অবাক হবেন, বেশ বড়সড়ো ধাক্কা খাবেন। প্রথম ধাক্কাটি হবে তিনি এত আগে মানুষের চরিত্র নিয়ে কত অগ্রসর স্টাডি করেছিলেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় তিনি খুবই নির্মম বা ঘৃণ্য কথা বলেছেন। চাণক্যকে পড়ার ক্ষেত্রে অন্ধ হওয়া যাবে না। তার গ্রহণযোগ্য মতগুলো নিয়ে ভাবনার জায়গা রয়েছে আবার বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য মতকে নির্মম হাতে বাতিল করতে হবে।

নারী প্রসঙ্গে চাণক্যের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই নিম্নতর। যদিও ব্যক্তিজীবনে মাকে অনেক সম্মান করতেন এবং তার গড়ে উঠার পেছনে মায়ের অবদান বেশ বলে জানা যায় তারপরও নারীদের নিয়ে তিনি সমকালের সাধারণ সিদ্ধান্ত থেকে বেশিদূর আগাতে পারেননি। মৌমাছি যেমন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে নেয় তেমনি চাণক্যের কাছ থেকে আমরা শুধু মধুগুলোই নেই, গরলগুলো না হয় বাদ গেলো।

চাণক্যে যতসব মধু আছে সেগুলো জীবন সাজাতে অনেক উপকারে লাগবে যেমনটা উপকারে এসেছে গত দুই হাজার বছরে।

‘বোকা শিষ্যদের জ্ঞান বিলিয়ে পণ্ডিত লোকও দুঃখে পতিত হতে পারে, যেমনটা মূর্খরা রমণীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলে, কমবখত লোকের পাশে বেশিদিন থাকলে।’

উপরের কথাটির অর্থ হতে পারে বোকা শিষ্যরা গুরুর জ্ঞান ঠিকমতো নিতে পারে না, যতটুকু নেয় সেটা ভুল করে উপস্থাপন করতে পারে। এ কারণে বোকা শিষ্য গুরুর জন্য হতাশা নিয়ে আসতে পারে। আর ঘরে শান্তি নষ্ট করার জন্য এক মূর্খরা রমণীই যথেষ্ঠ। আর কমবখত লোকের আশেপাশে বেশি সময় অবস্থান করলে তার প্রভাব পড়বে সাধু লোকের উপরও। কারণ মানুষ তার পরিবেশ ও আশেপাশের লোকদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়। এজন্য শিষ্য, স্ত্রী বা সঙ্গী বাছাইয়ে খুব সতর্ক হওয়ারই পরামর্শ চাণক্যের।

চাণক্যের আরেকটি নির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বলেন: ‘ওই দেশে অবস্থান করো না যেখানে তোমার সম্মান নেই, তোমার জীবিকা অর্জনের সুযোগ নেই, তোমার বন্ধু নেই বা তুমি জ্ঞান অর্জন করতে পারো না।’

চাণক্যনীতি ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক প্রভাবশালী টেক্সট। সহজ ভাষায় অনেক শক্তিশালী কথা বলে দেওয়ার জন্য দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে টেনেছে চাণক্যের বাণী।

একজন যোগ্য পণ্ডিতের দিনগুলো কেমন হবে তার কথা বলতে গিয়ে কি সুন্দর কথাটিই না বলেছেন চাণক্য। তিনি বলছেন একটি দিনও যেন শেখা বহির্ভূত না হয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখো, অন্তত একটি বর্ণ হলেও! জ্ঞান নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন চাণক্য সেটা হলো চর্চার মাধ্যমেই জ্ঞান বিকশিত ও প্রস্ফূটিত হয়। চাণক্য বলেন: ‘চর্চায় না রাখলে জ্ঞান হারিয়ে যায়; অজ্ঞতায় থাকলে মানুষ হারিয়ে যায়, সেনাপতি না থাকলে সেনাদল হারিয়ে যায় এবং স্বামী না থাকলে হারিয়ে যায় নারী।’

‘একজন জ্ঞানহীন মানুষের জীবন কুকুরের লেজের মতো অনর্থক/বেহুদা যেটা তার পশ্চাৎদেশও ঢাকতে পারে না আবার পোকামাকড়ের কামড় থেকেও বাঁচাতে পারে না।’

ধন-সম্পদ, আহারাদি, বস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদির বেলায় অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা বলা হলেও জ্ঞানের বেলাতে অল্পতে তুষ্ট হতে নিষেধ রয়েছে চাণক্যের। জ্ঞানহীন মানুষের জীবন খুবই জঘন্য বলে মনে করেন চাণক্য। তিনি বলেন: ‘একজন জ্ঞানহীন মানুষের জীবন কুকুরের লেজের মতো অনর্থক/বেহুদা যেটা তার পশ্চাৎদেশও ঢাকতে পারে না আবার পোকামাকড়ের কামড় থেকেও বাঁচাতে পারে না।’ জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তধন চাণক্যের কাছে। এর উপকার বহুবিধ।

সুগন্ধী বৃক্ষ যেমন পুরো বনকে সুগন্ধে ভরে ফেলে তেমনি পরিবারে একটি পূণ্যবান সন্তান পুরো পরিবারকে মহীয়ান-গরীয়ান করে তোলে। আবার একটি গাছে আগুন লাগলে যেমন পুরো বন পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে তেমনি পরিবারে একটি কুলাঙ্গার সন্তানের কারণে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন: ‘রূপ, যৌবন থাকলে ও অভিজাত বংশে জন্মালেও সেটা মূল্যহীন যদি তার জ্ঞান না থাকে।’ সুখী মানুষের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে চাণক্য বলেন: ‘যে ব্যক্তি আর্থিক লেনদেনে, জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে, খাওয়া ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে লজ্জা ছেড়ে দেয় সে সুখি হয়।’

চাণক্যনীতি ও নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স একসাথে পড়া যেতে পারে। রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে দুটি বই খুবই প্রাসঙ্গিক ও বেশ মিল রয়েছে তাদের মধ্যে। এছাড়া মহাভারতের গীতা অংশ ও ভীষ্মের উপদেশগুলো পড়া যেতে পারে। রাষ্ট্রনীতি ও ব্যক্তিগত জীবন ব্যবস্থাপনায় এগুলো খুবই উপকারী বলে মনে হবে। ক্লাসিক চিরায়ত বইয়ের উপর নির্দ্বিধায় আস্থা রাখা যায় এই কারণে যে সেগুলো শত শত বছর ধরে মানুষের কাজে লেগে আসছে এবং সেগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক।

চাণক্য এমন এক পণ্ডিত, দার্শনিক যে তার জীবদ্দশাতেই তার চিন্তার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পেরেছেন। গ্রীসের প্লাতো ‘দার্শনিক রাজা’ বা শক্তিশালী রাজার কল্পনা করতে পারলেও জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন দেখতে পারেননি। চাণক্য সেখানে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পত্তনের পেছনে প্রধান দ্রষ্টার ভূমিকা পালন করেন, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন আর তার মৃত্যুর পরও তার চিন্তা মৌর্য্য সাম্রাজ্য ও তৎপরবর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে অনেক প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।

আধুনিক ভারতবর্ষও চাণক্যের প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি।

 

৬.  দ্য প্রিন্স-নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি

প্রিন্স চাকুরীর জন্য আবেদনপত্র। ম্যাকিয়াভেলি যে একজন দক্ষ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং সে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা ভালো বুঝে সেটা দেখানোর প্রয়াসে লরেনজো দে মেডিসিকে উৎসর্গ করে প্রিন্স লিখেন। খুবই ট্রাজিক বিষয় হচ্ছে যাকে উদ্দেশ্য করে সেটি লিখেছিলেন সে পড়তে ও উপকৃত হতে পারেনি বলেই মত্ কারন বছর দুয়েকের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এরপর অপর আরেকজন প্রিন্সকে উৎসর্গ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেও নাকি মারা গিয়েছিল। মানে ম্যাকিয়াভেলি মারা যান বেশ ব্যর্থ মানুষ হয়েই। নিজের বইয়ের এরকম সফলতা দেখা তো দূরের কথা তার চিন্তার সফল প্রয়োগটা তিনি নিজে দেখে যেতে পারেননি। অথচ শত শত মানুষ অনুপ্রেরণা নিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে।

‘ডিসকোর্সেস অন লিবি’ লিখতে গিয়ে প্রিন্সের কথা মাথায় আসে। আসলে তখন তার চাকুরী দরকার ছিল। সে যে রাষ্ট্র কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সক্ষমতা রাখে সেটা দেখানোর জন্য প্রিন্স লেখা শুরু করেন। মাত্র তিন মাসে সেটা লেখা শেষ করেন বলে জানা যায়।

বইটি নিয়ে আরেকটা মজার তথ্য হচ্ছে এটার নাম দ্য প্রিন্স বা প্রিন্সিপালিটিজ কিছুই রেখে যাননি ম্যাকিয়াভেলি। তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এটা প্রকাশিত হলে সম্পাদকরা এমনতর নাম রাখেন।

বইটি মূলত দুটি মূল থিমের উপর লেখা/আবর্তিত:

১. কীভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়

২. কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়

বইটির প্রথম অর্ধভাগে ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন আর শেষ অর্ধভাগে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন। এটা হলো সহজ বিভাজন।

এথিক্স ও থিওলজি থেকে রাজনীতির জুদা ঘোষণা করেছেন ম্যাকিয়াভেলি।প্রায় দেড় যুগের মতো কূটনীতিক/দূত হিসেবে ইউরোপের প্রধান শক্তিঘর এবং তাদের প্রধান চরিত্রদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন ম্যাকিয়াভেলি। পাওয়ার কিভাবে আচরণ করে, এর সত্যিকার স্বরূপ তা সরাসরি দেখেছেন। তাকে নাস্তিক বলা হলেও সে বিশ্বাসী খ্রিস্টানই ছিলেন। তবে তার আলোচনায় ধর্মকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতির আসল রূপটা এবং ক্ষমতায় সফল হওয়ার ফর্মূলা জানিয়েছেন।

সিজার বোর্গিয়ার কর্মকাণ্ড খুব গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন। সফল শাসকদের কিছু গুণের সামঞ্জস্য দেখতে পেয়েছেন।

বইটির মাধ্যমে চাকুরী খুজেছেন ম্যাকিয়াভেলি কিন্তু এর মাধ্যমে রাজনীতিবিজ্ঞানের ইতিহাসে বেশ সম্মানের জায়গা নিয়ে ফেললেন। ম্যাকিয়াভেলি তার সে সফলতা দেখে যেতে পারলেন না সেটা ট্রাজিক ঘটনা।

সিসেরো দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। গদ্যে সেই গতি ও সৌন্দর্য ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৬শ শতকে ইউরোপে ঘৃণিত হয়ে আসলেও খুব শীঘ্রই ম্যাকিয়াভেলির মান বাড়তে শুরু করে। বিখ্যাত কয়েকজন দার্শনিক এটার ভালো ব্যাখ্যা দাড় করান। দার্শনিক স্পিনোজা তার ‘ট্রেকটেটাস থিওলজিকো পলিটিকাস’ বইয়ে ম্যাকিয়াভেলিকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব লিবার্টি’ বলেছেন।

এদিকে ফরাসী বিপ্লবের তিন কারিগরের দুজন খুবই সমীহ করেছেন ম্যাকিয়াভেলিকে। রুশো তার বিখ্যাত ‘সোস্যাল কনট্রাক্ট’ বইয়ে বলেন: ‘তিনি আসলে শাসকদের উপদেশ দেওয়ার বান করে সাধারণ জনতাকে দীক্ষিত করছেন।’

ফরাসী বিপ্লবের অপর ইঞ্জিনিয়ার দিদেরো তার ‘এনসাইক্লোপেডিয়া’ বইতেও ম্যাকিয়াভেলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সমসাময়িকরা যে তার সাথে ভুল আচরণ করেছে সেটার কথা বলতে গিয়ে দিদেরো বলেন: ‘তারা (ম্যাকিয়াভেলির সমর্থকরা) যদি ভুল বুঝে তাহলে এটা তাদের দোষ কারণ তারা একটি স্যাটায়ারকে ইউলজি বা প্রশংসাবাণী মনে করেছে।

আমাদের সময়কালের কয়েকজন আলোচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে ম্যাকিয়াভেলির ছকে ফেলে দেওয়া যাবে। দেখা যাবে তারা কিভাবে ম্যাকিয়াভেলির চিন্তার প্রতিমূর্তি। ভ্লাদিমির পুতিন এর ক্যারিয়ার অভিযানে নজর দিলে দেখবো ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাকে। ট্রাম্পের উত্থানে দেখবো ম্যাকিয়াভেলি, টনি ব্লেয়ার তার পুরো ক্যারিয়ারে বারে বারে ম্যাকিয়াভেলিয়ান হিসেবে গালির শিকার বা সমীহের ভাগিদার হয়েছেন। টনি ব্লেয়ারের প্রথম বছরে ম্যাকিয়াভেলিয়ান শব্দটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়  ৩৫৮ বার উচ্চারিত হয়েছে ।

রিচার্ড নিক্সন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিনজারের বিছানার পাশে একখণ্ড প্রিন্স থাকতো বলে জানা যায়। আর ফ্যাসিবাদী নেতা ইতালীর মুসোলিনি ‘দ্য প্রিন্স’ এর উপর থিসিস করেছিলেন। ইতালীর কমিউনিস্ট চিন্তক ও নেতা আন্তোনিও গ্রামসি।

নেপোলিয়ন ‘প্রিন্স’ পড়েছেন, স্টালিন তার মার্জিনে মন্তব্য লিখেছেন, মুসোলিনি এর উপর তো থিসিসই লিখে ফেলেছেন।  হেনরি কিসিঞ্জারকে তো তার ভক্ত বা সমালোচকরা আমেরিকার ম্যাকিয়াভেলি বলে থাকেন।

দক্ষ ডাক্তারের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের বিভিন্ন রোগবালাই এবং সেগুলো থেকে আরোগ্য লাভের উপায় বাতলে দিয়েছেন। তার যুক্তি সহজ ও স্পষ্ট। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় তেমনি রাষ্ট্রীয় রোগবালাই সমাধানে প্রাথমিক স্তরেই হাত দিলে সমাধান আসতে পারে। বেশি ঘনিয়ে গেলে রোগ মুক্তি যেমন সম্ভব নয় তেমনি যদি প্রথমদিকেই সমস্যা সমাধানে হাত না দেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রের ভয়াবহ পরিণাম এড়ানো সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন শাসকের অনেক অস্ত্র বা ছলাকলা থাকে। তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে ভয়। ভালোবাসা  ও ভয়ের মধ্যে যদি একটা গ্রহণ করতে বলা হয় তাহলে শাসককে ভয়ের অস্ত্র হাতে নেয়ার তালিম দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি।

রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন শাসকের অনেক অস্ত্র বা ছলাকলা থাকে। তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে ভয়। ভালোবাসা  ও ভয়ের মধ্যে যদি একটা গ্রহণ করতে বলা হয় তাহলে শাসককে ভয়ের অস্ত্র হাতে নেয়ার তালিম দিয়েছেন ম্যাকিয়াভেলি। এছাড়া যুদ্ধকে একজন শাসকের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করেন ম্যাকিয়াভেলি। সান জুর মতো তার বইটির নামও ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’। একই সঙ্গে ম্যাকিয়াভেলি প্রচলিত সামরিক ব্যবস্থার বদলে নতুন সামরিক বাহিনীর আইডিয়া দেন। আধুনিক রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর ধারণা অনেকটা ম্যাকিয়াভেলির কাছ থেকেই পাওয়া। এর আগে বিভিন্ন শাসক সৈন্যদলের জন্য মার্সিনারি সেনাদলের উপর নির্ভর করতেন। ম্যাকিয়াভেলি তার প্রিন্সে দেখিয়েছেন কিভাবে এটা ক্ষতিকর হতে পারে। নিজ ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের দিয়েই সেনাদল গড়তে হবে। এটা অনেক শক্তিশালী ও দৃঢ় বলে মনে করেন তিনি। জনতাকে নিরস্ত্র করার মেডিসিয়ান পলিসি দেশকে দুর্বল করে দেয়। ম্যাকিয়াভেলি দেখেছেন কিভাবে ইতালিয়ান শহরগুলো ফ্রান্স, স্পেন বা অন্যান্য শক্তিশালী রাজের দখলে চলে যেতো।

আজকের কোন তরুণ কেন প্রিন্স পড়বে, আপনি কেন পড়বেন-এই প্রশ্নগুলো আসলে বলতে হবে:

আপনি পড়েন বা না পড়েন আপনার বিরোধি শক্তি সেসব অনুসরণ করে যার কথা ম্যাকিয়াভেলির মতো লোকেরা বলে গেছেন। প্রত্যেকেই যে যেখানে আছেন না কেন আপনি যদি বেঁচে থাকেন বা বেঁচে আছেন বলে মনে করেন নিজেকে বক্সিং রিংয়ে আবিষ্কার করবেন।

আপনার সামনে অপশন সীমিত। যুদ্ধ করতে হবে, হামলা ঠেকাতে হবে। তা না হলে আপনি প্রথমেই নকড ডাউন হয়ে পৃথিবীর লড়াইয়ে টিকে থাকার সক্ষমতা হারাবেন। এখন ম্যাকিয়াভেলির শিক্ষা রাজনীতি, খেলাধূলা, সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, প্রযুক্তির দুনিয়া, এমনকি যেকোন কর্পোরেট হাউসে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আপনার ভাবের দুনিয়া, কল্পনার দুনিয়া, নৈতিকতার দুনিয়া যেমনটাই হউক না কেন, যেভাবেই আপনি দেখতে চান না কেন নির্মম বাস্তবতার ছবিটি এঁকেছেন ম্যাকিয়াভেলিরা।

পৃথিবী নামক যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি না হয় আগ্রাসী হামলাকারী হলেন না কিন্তু বিভিন্ন দিক থেকে আসা হামলা এড়াতে বা ঠেকাতে ম্যাকিয়াভেলিকে খুব আপনজন হিসেবে পাবেন। এটা যেকোন ব্যক্তির জন্য, যেকোন প্রতিষ্ঠানের জন্য আর যেকোন রাষ্ট্রের জন্য আরও বড় করে সত্য!

 

৭. দ্য লিটল প্রিন্স- অতোঁয়ান দ্য স্যান্ত একজুপেরি

গত শতকটি ছিল মানুষের জন্য আকাশে পাখা মেলার শতক।  বিশ শতকের একেবারে গোড়াতেই প্রথমবারের মত মিলিয়ন বছরের এই স্বপ্নটি সফল করে মানুষ।  বিমান আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে এই অনন্য ঘটনাটির জন্ম দেয়।  দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধে মানুষের উপর হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার কিংবা দুটি পারমানবিক বিষ্ফোরণের কাজে ব্যবহার করা হলেও এটি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ উল্লম্ফনের একটি।  মনে রাখতে হবে আকাশে উড়ার প্রযুক্তি আসার সাথে সাথে তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টর একটি বড় লাফ দিয়েছে। খুব দ্রুতই এটা উন্নততর ও বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। এই বিমান চালু হওয়ার প্রথমদিকে যারা বিমান চালাতেন তারা ছিলেন সমকালের নায়ক। প্রথমদিকে বেশি বিমান দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে বিমান চালনার পেশাতে যারা আসতেন তাদেরকে দু:সাহসী হিসেবেই দেখা হতো। এখনকার সময়ে মহাকাশে যারা কয়েকমাস বা বছরব্যাপী থাকেন তারা যেমন বড় তারকা হিসেবে স্বীকৃত হন  সে সময়ে বিমানের পাইলটরা ছিলেন এমন।

অঁতোয়ান দ্য স্যান্ত একজুপেরি হচ্ছেন প্রথমদিককার এমন একজন পাইলট।  সে সময়ে বিমান চালনা এবং আকাশযান বিষয়ক গল্প বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন সায়েন্স ফিকশন এবং নভোজান বিষয়ক গল্প-সিনেমা যেমন জনপ্রিয়।  ক্ষুদে যুবরাজ বা দ্য লিটল প্রিন্স স্রেফ বিমান সম্পর্কিত গল্প হওয়ার কারণেই এত জনপ্রিয় নয়।  এর সাথে রয়েছে দর্শন, কাব্য, রহস্য ও অভিযানের মসলা।

এই নভেলাটি ফরাসী ভাষায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ও বেশি অনূদিত বই হিসেবে স্বীকৃত।  বিশ শতকে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এটি।  এটি একই সাথে নৈতিক অ্যালিগরি আবার আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী।  মোহনীয় বর্ণনায় আমরা দেখি কিভাবে দূরের কোন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে পতিত হয় একটি ছোট্ট ছেলে, যে গল্পের ক্ষুদে যুবরাজ।  আমীর খানের ‘পিকে’ মুভির কথা মনে আসবে সেটি বলাই বাহুল্য।  সেরকমই অনেকটা।  দূর কোন গ্রহ থেকে এই ক্ষুদে যুবরাজ চলে এসেছেন এই পৃথিবীতে যে কীনা এই অদ্ভূতরে দুনিয়ার চালচলন কিছু বুঝে না।  একজন বয়স্ক বৈমানিক ক্ষুদে যুবরাজকে বিভিন্নভাবে দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন।  বড়দের দুনিয়ায় ক্ষুদে যুবরাজের শিক্ষণীয় ভ্রমণের কথা পাবো বইটিতে।  প্রতিটি মানুষের জীবনে কি কি দার্শনিক অভিঘাত আসতে পারে তার ইশারা আছে এই গ্রন্থে।  বইটিতে রয়েছে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ভালোবাসা নিয়ে আছে অবিস্মরণীয় কিছু উক্তি। সব ধরণের পাঠকদের জন্যই মসলা নিয়ে হাজির এই ‘ক্ষুদে যুবরাজ’।

৮. সক্রেতিসের জবানবন্দি-প্লাতো

সক্রেতিসের বাবা ভাস্কর আর মা ধাত্রী।  সক্রেতিস পরবর্তী জীবনে মা-বাবার পেশাকে ধরে রেখেছেন বলে মনে করতেন।  ধাত্রী যেমন কোন মানবশিশুকে পৃথিবীতে আসতে, জন্ম নিতে সহায়তা করতেন সক্রেতিসও তেমনি একজন জ্ঞানপিপাসুর জন্মের ক্ষেত্রে ধাত্রীর মতো ভূমিকা পালন করতেন।  আবার একজন ভাস্কর যেমন কঠিন পাথরকে কেটেকুটে সুন্দর মূর্তির রূপ দেন তেমনি দার্শনিক সক্রেতিস ও একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে নিপুণ ভাস্করের ভূমিকা পালন করেছেন। বৃক্ষ তোমার নাম কি-ফলে পরিচয়। এখন সক্রেতিস কেমন শিক্ষক ছিলেন তার প্রমাণ প্লাতো, অ্যারিস্টোটলদের মতো ওস্তাদদের পরম্পরা। তার প্রিয় এবং যোগ্যতম শিষ্যকে নিয়ে বলা হয়-‘পুরো পাশ্চাত্য দর্শন প্লাতোর ফুটনোট মাত্র’।

প্লাতোর প্রত্যেকটি লেখাতে প্রধান চরিত্র হিসেবে থেকেছেন সক্রেতিস। মনে হচ্ছে যেন সক্রেতিস কথা বলছেন আর প্লাতো নোট লিখছেন। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বয়স ত্রিশের দিকে গুরু সক্রেতিসের করুণ বিয়োগের ঘটনাটি এমনভাবেই তাড়িত করেছিল তরুণ প্লাতোকে যে সে তার পুরো জ্ঞানচর্চাকেই সক্রেতিসের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার প্লাতো প্রথমদিকে হয়তো সক্রেতিসের দর্শনই সক্রেতিসের মুখ দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার সেরা লেখাগুলোতে বা শেষদিকের লেখাগুলোতে নিজের দর্শন সক্রেতিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। সক্রেতিসের প্রতি তার একাত্ম আনুগত্য ও ভালোবাসার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের লেষমাত্র নেই।

‘সক্রেতিসের জবানবন্দি’তে এথেন্সের আদালতে দাড়িয়ে নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যুক্তির হাতুরি দিয়ে নিপুণভাবে খণ্ডন করেছেন সক্রেতিস। আদালতের সামনে তার পুরো জীবনের ভ্রমণটাও তুলে এনেছেন।  সত্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি তার একনিষ্ঠতার প্রমাণ ঠিকরে বের হবে প্রতিটি উক্তিতে। সক্রেতিসকে খুব কাছ থেকে বুঝতে হলে তার জবানবন্দি পড়তে হবে।  এর একাধিক বাংলা তর্জমা আছে।  ইংরেজিতেও অনেকগুলো সংস্করণ আছে।  যেকোন একটা পড়ে ফেলতে পারেন।

 

৯. দি হানড্রেড- মাইকেল এইচ হার্ট

আমার প্রিয় শিক্ষক উইল ডুরান্টের কথায় বলতে হয় ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’। বড় মানুষদের জীবন আমাকে বেশ টানে। এজন্য জীবনী, আত্মজীবনী, বড় মানুষদের কথা আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য বিষয়। মাইকেল এইচ হার্টের এই বিশ্বখ্যাত বইটিতে একসাথে একশো জন মহামানবের উপস্থিতে বইটিকে আমার কাছে অনেক আকর্ষনীয় করে তুলেছে।  এজন্য মাঝে মাঝে এই  বইটা থেকে কয়েকজন মহামানবের জীবনের উপর দিয়ে একটু ভ্রমণ করে আসি। মহামানবদের জীবন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে যে যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন সেগুলো আমাদের দৃষ্টি খুলে দেবে।  তার সাথে দ্বিমত করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তার যুক্তির কাছে বশ মানা ছাড়া সুযোগ খুবই সীমিত।

 

১০. হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-বাট্রার্ন্ড রাসেল

দর্শনের জগতে ঘুরে আসার জন্য একটি অসাধারণ বই।  ইংরেজি ভাষার একজন অসাধারণ গদ্যশিল্পী বাট্রার্ন্ড রাসেল।  তিনি নিজেও একজন শক্তিশালী দার্শনিক এবং দর্শনের সেরা শিক্ষকদের একজন। তার কাছ থেকে তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের গল্প শুনা একটি অসাধারণ সুযোগ।  বইটি সকল সিরিয়াস পাঠকের অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত।  রাসেলের গদ্য যেমন পাঠককে টানবে এবং প্রত্যেক দার্শনিককে নিয়ে করা তার মন্তব্য আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে।

দর্শনের ইতিহাসের উপর আরও যে কয়েকটি বই ভালো লেগেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্যামুয়েল ইনূচ স্টাম্ফের ‘সক্রেতিস টু সার্ত্রে: অ্যা হিস্ট্রি অব ফিলসফি’, ফ্রাঙ্ক থিলি’র ‘এ হিস্ট্রি অব ফিলসফি’ এবং উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’। সময় ও সুযোগ থাকলে সবগুলোও পড়া যেতে পারে।  তবে একটা দিয়ে যদি শুরু করতে চান তাহলে রাসেলকেই নিতে পারেন।

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ও এবং তার মৌলিক বিষয়াদির সঙ্গে পরিচয় লাভের জন্য অন্য আরেকটি বই বেশ ভালো লেগেছে সেটি হলো: রালফ ম্যাকলনার্নির ‘এ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’।  প্রায় সাড়ে আটশো পৃষ্ঠা প্রলম্বিত এই বইটির সবচেয়ে ভালো লাগার দিক হচ্ছে এর টসটসে ভাষা! ভাষা যেহেতু কোন বইয়ের জগতে প্রবেশের দরজা এ কারণে এ বইয়ে খুব সহজেই প্রবেশ করে ফেলতে পারবেন! সাইজ দেখে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এক সপ্তাহ বা পনের দিন পড়ে যদিও এটা শেষ করতে পারা যায় তাহলে সেটা হবে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বইটির বরাতে বেড়িয়ে আসতে পারবেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্দরমহলে এবং জেনে নিতে পারবেন এর হাড়ির খবর!

আমরা বইপত্র পড়ি নিজেকে বুঝার জন্য, নিজেকে জানার জন্য। পড়া শেষ হলে আপনার আসল কিতাবের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি নিজেই হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

আমরা বইপত্র পড়ি নিজেকে বুঝার জন্য, নিজেকে জানার জন্য। পড়া শেষ হলে আপনার আসল কিতাবের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি নিজেই হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব যা মনোযোগ সহকারে পাঠ ও অনুধাবন অনেক প্রয়োজনীয়।

পড়া শেষ হলে চলেন সামনে আগাই-

The post আমার পড়া সেরা ১০ টি বই appeared first on Bangladesh Study Forum.

জলপাই রঙের কোটঃ ভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প

$
0
0

বইয়ের নামঃ জলপাই রঙের কোট

বইয়ের ধরনঃ ঐতিহাসিক উপন্যাস (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লেখকঃ রবিউল করিম মৃদুল

প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ

প্রকাশনাঃ দেশ পাবলিকেশন্স

কোনো ইতিহাস জন্ম নেয় কালের পরিক্রমায়, সময়ের চলমান স্রোতে। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়াই সময়ের ধর্ম হলেও ইতিহাস কিন্তু বদলায় না। সময়ের সাথে সাথে স্থান-কাল-পাত্র বদলে গেলেও ইতিহাস অনড় রয়ে যায়। ইতিহাস মানুষের নায়কোচিত গল্প যেমন তুলে ধরে, তেমনি কাউকে কাউকে খলনায়কেও পরিণত করে। নশ্বর পৃথিবীতে মানুষের উত্থান-পতন যেমন ঘটে, তেমনি ইতিহাসে বর্ণিত গল্পগুলোতেও লাগে পরিবর্তনের ধাক্কা—-কখনো আকস্মিক, কখনো বা ধীরেসুস্থে! এখন যা ঘটছে, পর মুহূর্তেই তার ঠাঁই হয় ইতিহাসের পাতায়। অর্থাৎ সময়ের বদলে ঘটনাচক্র অতীত হয়ে যায়। তখন তার নাম হয়ে যায় ইতিহাস!

প্রতিটি স্বাধীন জাতির উত্থানের পেছনে একটি গল্প থাকে। এ গল্প হয়ে থাকে কখনো সংগ্রামের, কখনো দ্রোহের, আবার কখনো বা নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের। অন্য জাতির মত বাঙালি জাতির এ ইতিহাসও আকারে বেশ দীর্ঘ। কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে এর মাহাত্ম্য পরিমাপ করা খুব কঠিন। অসম্ভব বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়। সে ইতিহাসের গল্পকে বইয়ের পাতায় অক্ষরে রূপদান করেছেন তরুণ লেখক রবিউল করিম মৃদুল। কোনো মনগড়া গল্প নয়, সত্যিকারের গল্প অবলম্বনে এ দেশীয় ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এ দেশের ইতিহাস বলতে গেলে মূলত ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর —- এ সময়কালীন ইতিহাসের কথা ঘুরেফিরে মাথায় আসে। এত দীর্ঘকালীন ইতিহাসের বর্ণনা দিতে গেলে সেটা ঐতিহাসিক উপন্যাস না হয়ে ইতিহাসের এক প্রামাণ্য গ্রন্থ হয়ে ওঠে। আকারে ঢাউস সাইজের সেসব বই মানুষ কেবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও পড়ে থাকে। যাক সেসব কথা! লেখক এ বইতে স্বদেশী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ —– এ সময়কালের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সময়ের বিচারে বলতে গেলে এ ইতিহাসের সময়কাল ১৯০৫ থেকে ১৯৭১……৬৫ বছরের ইতিহাস।

বইটিতে স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের বীরোচিত সাহসিকতার গল্প বিবৃত করা হয়েছে। একজন পুরুষ কী করে দুনিয়ার সকল মোহ-মায়াকে পরিত্যাগপূর্বক  কেবল স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে এভাবে বলী দিয়ে দিতে পারে, মাস্টারদা তার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন। কর্মজীবনে সূর্যসেন এক হাইস্কুল শিক্ষক হবার সুবাদে সকলের কাছে মাস্টারদা নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি লড়ে গেছেন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে, স্বদেশের স্বাধীনতার দাবিতে। লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, দেশের ইতিহাসের উপরে অসংখ্য বই রচিত হলেও এ বীরের অবদানের ব্যাপারে তেমন বিস্তারিত কিছু কোথাও পাওয়া যায়না। এ বই সে অভাব অনেকাংশেই দূর করে দিবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে পূর্ববঙ্গের লোকেদের মধ্যে অনেক বিতর্ক থাকলেও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্যসেনের অকৃত্রিম ত্যাগ কোনোভাবেই অস্বীকার করবার মত নয়।

এর পাশাপাশি লেখক মোমবাতির মত নিরব দহনে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া এক নারীর জীবন সংগ্রামের গল্প তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, পর্দার অন্তরালে থেকেও কী করে এ সংগ্রামে শামিল হওয়া যায়! দূরে থেকেও ন্যায়রক্ষার সংগ্রামে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণাদায়িনী এ নারীটি আর কেউ নন—- তিনি স্বয়ং সূর্যসেনের অর্ধাঙ্গিনী। তার জীবন মোটেও আর দশটি সাধারণ গ্রাম্যবধূর ন্যায় ছিল না। হাতে মেহেদী, গায়ে নববধূর সাজ—-এ বেশে একজন সদ্য বিবাহিতা নারী বাসর ঘরে অপেক্ষমাণ। কল্পনার রঙিন পাখা যখন ঘরের চালের সীমানা পেরিয়ে মুক্তাকাশে মেলে ধরেছে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ,  স্বপ্নের পুরুষ তখন ব্যস্ত দেশের মুক্তি সংগ্রামের কাজে। যৌবনের টান উপেক্ষা করে যে পুরুষ একবার দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়েছে, সামান্য নস্যি নারীর কী সাধ্য তাকে মায়ায় বাঁধনে আটকে রাখবার? তিনিও পারলেন না। সদ্য কৈশোরে পা রাখা এ অনিন্দ্য সুন্দরী নারীও পারলেন না নিজেকে মায়ার বাঁধনে স্বপ্নের পুরুষকে বেঁধে ফেলতে। সকল মোহকে উপেক্ষা করে মাস্টারদা ছুটে চললেন অজানার পানে। পেছনে পড়ে রইলো তার সংসার, তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, তার এত অযত্ন- অবহেলার পরেও এ মহিয়সী নারী জীবনে একটি বারের জন্যেও স্বামীর বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিযোগ করেননি। জীবনের শেষ দিন অবধি এ ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয় ছিল।

এছাড়া আরেক নারীর নিরব অপেক্ষার গল্প তুলে ধরেছেন বইটিতে। কোনো রকম সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ছাড়াই কোনো নারী যে এভাবে কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারে, সেটা এ উপন্যাস পড়বার আগে জানা ছিল না। কেবল একজন পুরুষের মনের ভাষা বুঝতে পেরে এভাবে অজানা ভবিষ্যতের পানে পা বাড়ানো এখনকার যুগে অত্যন্ত  বিরল। এ থেকে এ কথাই  প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করলেও মনোবৃত্তিকে কখনো থামাতে পারে না। এ প্রসঙ্গে একটি জনপ্রিয় লোকগীতির দুই লাইন উল্লেখ না করে পারলাম নাঃ

“মনকে আমার যত চাই যে বুঝাইতে, / মন আমার চায় রঙের ঘোড়া দৌড়াইতে!”

বইয়ের আলোচ্য বিষয়বস্তু নিয়ে বস্তাপচা আলাপ কম তো হলো না। এবার আসা যাক এর ভাষাশৈলী ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনায়। ইতিহাসের মত কাঠখোট্টা ব্যাপারেও বেশ সাবলীল ও সহজ ভাষায় বর্ণনা করে গিয়েছেন লেখক। বলতে গেলে, এ ব্যাপারে তিনি বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে অস্বীকার করবার কিছু নেই তেমন। তবে গল্পের ধারা আমার কাছে এলোমেলো লেগেছে কিছুটা। খুব দ্রুত ঘটনার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসাতে নতুন ধারা ধরতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে। স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে ক্ষেত্রবিশেষে, এ কাজে আমাকে ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়েছে। এছাড়া আর তেমন অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো কিছু আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি বলতে গেলে। সর্বোপরি, বেশ ভালো মানের লিখনী ছিল বইটি। অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পেরেছি। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জ্ঞানের ভাণ্ডার একটু হলেও সমৃদ্ধ হয়েছে আগের তুলনায়।আশা করি, কোনো পাঠক আশাহত হবেন না বইটি পড়ে। বইয়ের রিভিউ লিখে দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে লেখক মহাশয় আমাকে বইয়ের মোবাইলে পাঠযোগ্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন। এ জন্য তার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা।

সবশেষে, এ লেখকের নতুন বইয়ের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো। “সাধারণ লোক পাঠক হয়ে উঠুক আর পাঠকেরা লেখক হয়ে উঠুক”—–এটাই হোক সকল বইপাগলের একমাত্র চাওয়া!

Happy reading!

The post জলপাই রঙের কোটঃ ভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প appeared first on Bangladesh Study Forum.

শূন্য বালুচরঃ সমসাময়িক কালের গল্প

$
0
0

শূন্য বালুচর

বইয়ের নামঃ শূন্য বালুচর
ঔপন্যাসিকঃ Tuffahul Jannat Maria
বইয়ের ধরণঃ সমসাময়িক উপন্যাস
প্রচ্ছদঃ জয়দেব
প্রকাশনাঃ ইন্তামিন প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৩০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪৮

উপন্যাস মানে জীবনের গল্পের ধারাবাহিক বর্ণনা। জীবনের কোনো দিক যখন ক্রমানুসারে কোনো শব্দের জাদুকরের হাত ধরে উঠে আসে কাগজের পাতায়, তখন তার নাম হয়ে যায় উপন্যাস। জীবনের সাধারণ গল্প তখন ঔপন্যাসিকের হাতের জাদুতে হয়ে ওঠে অসাধারণ। ছন্দ ও শব্দের কারুকার্যময় চর্চায় তা তখন লাভ করে নতুন দ্যোতনা।

এমন-ই এক সাধারণ গল্প নিয়ে পাঠক সমাজে হাজির হয়েছেন তরুণ লেখিকা তুফফাহুল জান্নাত মারিয়া। নবীন এ লেখিকা অনেক দিন যাবত ভার্চুয়াল জগতে লেখালেখি করলেও এটি তার প্রকাশিত প্রথম কোনো বই। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের গল্পগুলো আমাদের কাছে নিতান্তই সাধারণ মনে হয়। কিন্তু সে গল্পের সাথে যখন সংযোজনা হিসেবে যুক্ত হয় শব্দের কারসাজি, তখন সাধারণ গল্পটাও হয়ে ওঠে অনন্যসাধারণ। এখানে লেখকের ভূমিকাই সবচাইতে মুখ্য ব্যাপার। যা হোক, তাত্ত্বিক আলোচনা বাড়াতে চাইনা। এতে পাঠকের বিরক্তির বাড়বে বৈ কমবে না। যা হোক, কাজের কথায় আসা যাক। উক্ত উপন্যাসটিতে এক দরিদ্র পরিবারের সন্তানের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। পরিবারের সন্তান হিসেবে তার দায়িত্ববোধ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা পারিপার্শ্বিকতা বেশ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা মহাশয়া। একই সাথে উক্ত উপন্যাসটিতে স্থান পেয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের পার্শ্বচরিত্রগুলো। এ সংযোজন গল্পটিতে যুক্ত করেছে আলাদা মাত্রা। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রায়নের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার যথাযথ প্রয়োগ এটিকে আলাদা করে তুলেছে অন্য বইয়ের থেকে। এটিকে এ উপন্যাসের আলাদা স্বকীয়তা হিসেবে সহজেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।

এবার আসা যাক শব্দচয়ন সংক্রান্ত আলোচনায়। পুরো উপন্যাস জুড়েই শব্দের ব্যবহার বেশ ভালোই লেগেছে আমার। শব্দচয়ন তেমন খারাপ লাগেনি। প্রথম প্রকাশিত বই হিসেবে শব্দের প্রয়োগ বেশ ভালোই ছিল সর্বোপরি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি চোখে পড়েছে। যেমনঃ বইয়ের মধ্যে বেশ কিছু স্থানে বানান সংক্রান্ত ভুল দৃষ্টি এড়ায়নি। এছাড়া বইয়ের অনুচ্ছেদগুলো অপেক্ষাকৃত দ্রুত বদলে যাওয়ায় কখনো কখনো আগের প্রেক্ষাপটের সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে অল্পবিস্তর বেগ পেতে হয়েছে। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ফলাফল। অন্যরা এ নিয়ে আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন।

কথা বাড়াবো না আর! ইতোমধ্যেই পোস্টের আকার ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করবার জোগাড় হয়েছে। অন্তত এখনকার স্বল্পাকৃতির লেখা পড়তে অভ্যস্ত ফেসবুক প্রজন্মের কাছে এমনটা মনে হলে মোটেও অবাক হবোনা আমি।বরং মনে হবে, এটাই তো হবার কথা ছিল। যা হোক, নবীন এ লেখিকার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা

নবাগত দিনগুলো তার আনন্দময় ও সুখের হোক।

Happy Reading!

The post শূন্য বালুচরঃ সমসাময়িক কালের গল্প appeared first on Bangladesh Study Forum.


গহন মায়াঃ প্রণয় ও দেশপ্রেমের অপূর্ব মিশ্রণে লেখা এক ব্যতিক্রমী গল্প

$
0
0
বইয়ের নামঃ গহন মায়া
লেখিকাঃ সুমনা মৃধা (Sumona Mridha)
বইয়ের ধরনঃ রোমান্টিক উপন্যাস
প্রচ্ছদঃ জয়দেব
প্রকাশনাঃ ইন্তামিন প্রকাশন
প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা, ২০১৮
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮০
উপন্যাস মানে ধারাবাহিক জীবনের গল্প। বাস্তবতার গল্প যখন কোনো বইয়ের পাতায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখে লিপিবদ্ধ হয়, তখন তার নাম হয়ে ওঠে উপন্যাস। মানব সম্পর্ক, প্রণয় তথা হৃদয়ের টান যেমন মানুষের জীবনেরই এক বড় অংশ জুড়ে থাকে, তেমনি উপন্যাসের পাতা জুড়ে স্থান পায় সমাজ কর্তৃক নিষিদ্ধ মানব-মানবীর সে চিরন্তন আকর্ষণ। সমাজে নিষিদ্ধ হলে কী হবে? মন তো সে বাধা মানে না!

এমন-ই এক হার না মানা প্রেমের গল্পভিত্তিক উপন্যাস নিয়ে পাঠক সমাজে হাজির হয়েছেন নবীন লেখিকা সুমনা মৃধা। ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় তার লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি ছিল তার লেখা প্রথম প্রকাশিত কোনো বই। এটি তার প্রথম উপন্যাস ও দ্বিতীয় প্রকাশিত বই। এক অনবদ্য প্রেমের গল্প তুলে ধরা হয়েছে বইটির প্রতিটি পরতে পরতে। ভালবাসা যে সকল বাধা অতিক্রম করে টিকে থাকে কালের পরিক্রমায়, সে ব্যাপারটিই এখানে মূলত উঠে এসেছে। এছাড়া ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে কী করে ভালবাসা এগিয়ে যায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে, সেটিই এখানে তুলে ধরেছেন এ তরুণ লেখিকা। পাশাপাশি ক্ষুদ্র পরিসরে গল্পচ্ছলে উঠে এসেছে বাঙালির আত্মত্যাগের ইতিহাস…… উঠে এসেছে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প। যুদ্ধের গল্পের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক সদ্য বিবাহিত যুবক কী করে নববিবাহিতা স্ত্রীর মোহ কাটিয়ে দেশমাতৃকার ডাকে আত্মহারা হয়ে উঠতে পারে, সে গল্প। এ দিকটি উপন্যাসটিকে আলাদাভাবে মহিমাণ্ডিত করে তুলেছে।

এবার আসা যাক বইয়ের ভাষাশৈলীগত ব্যাপারে। সহজ ভাষায় ও অল্প কথায় বলতে গেলে, বইয়ের ভাষাশৈলী বেশ চমকপ্রদ লেগেছে আমার কাছে। নিজস্ব ভঙ্গিমায় লিখনীর মাধ্যমে তিনি আবেগের ব্যাপারটিকে আরো বেশি আবেগময় করে তুলেছেন। বিভিন্ন উপমার যথাযথ প্রয়োগ এটিকে আরো বেগবান করেছে। একজন পাঠক হিসেবে এ ব্যাপারটি বেশ উপভোগ্য লেগেছে আমার কাছে। ঔপন্যাসিকের কবিসত্তা তাকে এ ধরনের লেখা লিখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার ধারণা। সর্বোপরি কোনো পাঠক বইটি পড়ে আশাহত হবেন না বলে আমার বিশ্বাস।

সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রিয় অনুজ এ লেখিকার প্রতি রইলো অকৃত্রিম শুভকামনা ও ভালবাসা……. সমৃদ্ধ ও সুন্দর হোক আগামীর পথচলা!

The post গহন মায়াঃ প্রণয় ও দেশপ্রেমের অপূর্ব মিশ্রণে লেখা এক ব্যতিক্রমী গল্প appeared first on Bangladesh Study Forum.

আপনার পড়া সেরা ১০টি বই কী কী?

$
0
0

নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে একবার এক লোক জিজ্ঞেস করল, হোজ্জা ,আপনার বয়স কত? হোজ্জা উত্তর দিলেন, আমার বয়স ৬০ বছর ।

বেশ কয়েক বছর পরে সেই লোকের সাথে আবার হোজ্জার দেখা । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনার বয়স কত হল বলুন তো। নাসিরুদ্দিন উত্তর দিলেন, আমার বয়স ৬০ বছর।

লোকটি বলল,সে কি কথা ? ৫ বছর আগেও তো আপনি ৬০ বছরের কথাই বলেছিলেন। উত্তরে হোজ্জা গম্ভীর মুখ করে বললেন, আমি এক কথার মানুষ। এক মুখে ২ কথা বলতে পারব না ।

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মত করে বয়স ধরে রাখা সম্ভব না । সময়ের সাথে সাথে আমাদের বয়স পাল্টায়, পাল্টায় আমাদের মেন্টালিটি; চারপাশের জগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে আসে পরিবর্তন। নতুন বাড়তি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আমরা পৃথিবীকে আরো ভালভাবে বুঝতে শিখি। সেই কারনে আজ আমাদের যা ভাল লাগছে, যেটাকে অতি প্রয়োজনীয় বই বলে মনে হচ্ছে, কয়েক বছর পরে সেটাকে হয়তো রাবিশ ছাড়া আর কিছুই মনে হবেনা । বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ নামক ছোটগল্পে ঠিক এইরকম একটা সিনারিও বর্ননা করা হয়েছে। গল্পের নায়ক ট্রেন স্টেশনে বসে সহযাত্রীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে একটি বই পড়া শুরু করলেন । বইটা তার এতই ভাল লেগেছিল যে নিজের ট্রেন ফেইল করেও তিনি কয়েক ঘন্টা ধরে বইটা পড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। শেষ পর্যায়ে এসে আবিষ্কার করলেন, বইয়ের লাস্টের কয়েকটি পৃষ্ঠা ছেড়া। বইটা তার আর কমপ্লিট করা হলনা। প্রায় ১০ বছর পরে সেই বই আবার তার হাতে আসল। তিনি পড়তে গিয়ে দেখলেন, বইটা খুবই খারাপ। সময় নষ্ট করে এ বই পড়ার কোনো মানে হয়না । (পাঠকের মৃত্যু নামক গল্পটা পড়তে পারেন এই লিংক থেকে https://www.facebook.com/FanClub.Humayun.Ahmed/posts/608924179149368)

বনফুল নামক পাঠক ১০ বছরের ব্যবধানে যেভাবে সম্পূর্ন চেঞ্জড হয়ে গিয়েছিলেন , আমাদের প্রত্যেকের সাথেই সেটা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আজ আমাদের কাছে যেটা সেরা বই মনে হচ্ছে , কিছুদিন পরে সেটা হয়তো অশ্লীল চটি বইয়ের সমতুল্য বলে গন্য হবে।বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম এর সেরা নির্বাচনের ইভেন্টে আজ সেরা ১০টি বয়ের তালিকা যদি করতে বসি ,তাহলে সেটা All time universal best 10 হবেনা , সেটা হবে কেবলমাত্র ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ বসে তৈরি করা একটা লিস্ট।

বিডিএসএফ এর ইভেন্টকে সামনে রেখে সচেতন পাঠকদের উদ্দেশ্যে ভয়ে ভয়ে আমার এখনকার লিস্টটা পেশ করছি ।

১। গল্পে গল্পে জেনেটিক্স (চমক হাসান)
এই আধুনিক যুগে এসেও আমরা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই, গর্ভের সন্তান ছেলে না হয়ে মেয়ে হবার কারনে স্ত্রীকে তালাক দিলেন স্বামী। নবজাতক দেখতে কার মত হল ?–বাবা নাকি মা ? বাবা মা দুইজনেই ফর্সা, বাচ্চা যেহেতু কালো হয়েছে তার মানে ডাল মে কুছ কালা হে ? —এইরকম অসংখ্য কুসংস্কার বা অজ্ঞানতা এখনো আমাদের মাঝে রয়েছে । গল্পে জল্পে জেনেটিক্স বইটা এইধরনের সকল কনফিউশন দূর করে জেনেটিক্স বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে । বাইবেলে বর্নিত ইয়াকুব (আ) এর ভেড়ার পালের কৌশলী প্রজনন থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের মেন্ডেলের সূত্র কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং — বইতে সবকিছুই বর্ননা করা হয়েছে । বইয়ের ভাষা খুবই প্রাঞ্জল ।যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সায়েন্স নয়, তারাও এই বই পড়ে সহজেই বুঝতে পারবেন আশা করা যায় ।

Image may contain: text

আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, বইটা লেখা হয়েছে কার্টুন এর ফরম্যাটে । পাতায় পাতায় ছবি, ছবির নায়ক নায়িকাদের সংলাপের মধ্য দিয়ে বই এর থিওরি এগিয়ে যাচ্ছে । যে কোনো বয়সের পাঠকই এই বই পড়ে উপকৃত হবেন।

বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন এ্যামাইটোসিস বা মাইটোসিস (নন সেক্সুয়াল) কোষ বিভাজনের চেয়ে মিয়োসিস (সেক্সুয়ায়াল) কোষ বিভাজনে কি কি সুবিধা পাওয়া যায়। বইটি পড়লে আপনি আরো জানতে পারবেন , অস্ট্রিয়ার গির্জার পাদ্রি গ্রেগর জোহান মেন্ডেল তার বাগানে লাগানো মটরশুটির ফুল পর্যবেক্ষন করে কোন যুগান্তকারী ফর্মূলা আবিষ্কার করেছিলেন। এই বইটিতে আপনি আরো পাবেন সন্তানের ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় থাকা লিথাল জিন (বা থ্যালাসেমিয়ার মত অন্যান্য জেনেটিক রোগ) এর ক্ষতিকর প্রভাব। বইটি পড়লে আপনি আরো জানতে পারবেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বানানো গরুর মাংসের গাছ বা জোনাকি পোকার মত আলোকিত খরগোশের খবর। তাই আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের বইগুলি । মানে , আসুন নিকটস্থ বইয়ের দোকানে/লাইব্রেরিতে/অনলাইনে, পড়ুন এই বইটি।

২। স্যাপিয়েন্স -মানুষের গল্প , (ইউভাল নোয়া হারারি -আশফাক আহমেদ)
অন্স আপ অন এ টাইম , মেনি ডেইজ এগো, এক দেশে ছিল এক রাজা । একদিন রাজা তার সকল মন্ত্রী,সচিব এবং দেশের গন্য মান্য বুদ্ধিজীবিদের ডেকে আনলেন । সবাইকে মিটিং এ ডেকে বললেন, , পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যত জাতি এসেছে, তাদের উত্থান -পতন এবং তাদের অবদান গুলো সম্পর্কে আমি জানতে চাই । তোমরা সবাই মিলে চেষ্টা করো ,পৃথিবীর সকল জাতির ইতিহাস লেখার জন্য । এই ইতিহাস পড়ে আমি বুঝতে পারব, আমার নিজের সাম্রাজ্যের জন্য আমার করনীয় কি । আচ্ছা, কতদিন লাগবে তোমাদের এই ইতিহাস লেখার জন্য ?

সবাই আলোচনা করে রাজাকে বলল, আমাদের ৫ বছর সময় দিলে আমরা আপনাকে পূর্নাংগ ইতিহাস লিখে এনে দিতে পারব । রাজা বললে, ঠিক আছে । ৫ বছর পরে ঠিক এই দিনে আমরা এখানে আবার মিটিং এ বসব ।

No automatic alt text available.

৫ বছর পরের কথা । রাজা সবাইকে নিয়ে আবার মিটিং এ বসেছেন । কারো হাতে কোনো বই নেই । রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় সেই ইতিহাস গ্রন্থ ? তোমরা কি লিখে এনেছো আমাকে দেখাও ।

প্রধান লেখক উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন । জানালা দিয়ে দেখা গেল, প্রাসাদের সামনে সার দিয়ে ৩০ টা উট দাড়িয়ে আছে । প্রতিটা উঠের পিঠে ২ বস্তা করে বই ।

প্রধান লেখক কুর্নিশ করে বললেন, মহারাজ-এই হচ্ছে আমাদের ৫ বছরের পরিশ্রমের ফসল ।এখানে পৃথিবীর প্রতিটা জাতির ইতিহাস রয়েছে ।

রাজা বললেন, এত বই আমি পড়ব কখন ? তোমরা এক কাজ করো। আমার জন্য সংক্ষিপ্ত করে ইতিহাস লিখো । কতদিন লাগবে তোমাদের এই কাজে ?

সবাই আলোচনা করে বলল, ১ বছর সময় দিলে আমরা একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখে আনতে পারব ।

১ বছর পরের সকাল । রাজা আসলেন মিটিং এ । প্রধান লেখক জানালার পর্দা সরিয়ে দিল । দেখা গেল, এবার উটের লাইনে মোট উট এর সংখ্যা ৫ । প্রতিটা উঠের পিঠে ২ বস্তা বই ।

রাজা এবার খেপে গেলেন । আরে –এত বই আমি কিভাবে পড়ব ? আপনারা দেশের সেরা সেরা বিদ্বান ব্যক্তি । আপনারা কি আমার জন্য এমন কোনো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে পারেন নাই যেখানে পৃথিবীতে জন্মানো প্রতিটা জাতির ইতিহাস লেখা থাকবে ?
প্রধান লেখক বললেন , জি জাহাপনা , আমরা পারব ।
-কতদিন লাগবে আপনাদের ?
-১ দিন লাগবে । আগামীকালই আপনার ইতিহাসের বই পেয়ে যাবেন ।
-ওকে ঠিক আছে । কাল যদি বইটা দিতে না পারো , তোমার ফাসি দিব আমি । তোমাদের সবার মৃত্যুদন্ড হবে ।

পরেরদিন সকাল । রাজা এসেছেন । মহা ধূমধাম করে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে প্রধান লেখক রাজার হাতে মখমলের কাপড়ে মোড়ানো একটি বই তুলে দিল । মোড়ক উন্মোচনের পরে রাজা বইটা খুললেন । বই এর ভিতরে মাত্র একটি পৃষ্ঠা । সেই পৃষ্ঠায় মাত্র একটা লাইন । সেখানে লেখা রয়েছে ,”তারা জন্মেছিল, তারা বেচেছিল, এবং তারা মারা গিয়েছিল।”

পৃথিবীতে জন্মানো প্রতিটা মানুষ কিংবা প্রতিটা জাতির ইতিহাস খুজে বের করে একজায়গায় কম্পাইল করা খুব কঠিন কাজ । অনেকেই নিজেদের সাধ্যমতো সেই চেষ্টা করেছেন । তবে এসব ইতিহাসের অধিকাংশই খন্ডিত ইতিহাস । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা একই ছকে ফেলে বিশ্লেশন করা খুব কঠিন কাজ । সেই কাজটাই করেছেন ইজরায়েলের ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি ।২০১৪ সালে তিনি Sapiens: A Brief History of Humankind নামে একটি বই লিখেন । বইটাতে প্রায় ৪০ লাখ বছর ধরে ঘটে যাওয়া মানুষের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন পর্যায় বর্ননা করা হয়েছে । সেই সাথে জেনেটিকাল কিংবা বিবর্তনগত কারনে বর্তমান সময়ে হোমো স্যাপিয়েন্সের ভিতরে রয়ে যাওয়া বিভিন্ন কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে ।

বিষয়বস্তুকে তুলনা করলে এই বইএর সাইজ ৩০ টা উট বোঝাই বই এর বস্তার সমান । কিন্তু পৃষ্ঠা সংখ্যা হিসাব করলে এই বইটা একপাতার পুস্তিকার সাথে তুলনীয় । আশফাক আহমেদ নামের এক বাংলাদেশী বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার এই বইটাকে ভাবানুবাদ করেছেন । নাম দিয়েছেন ‘মানুষের গল্প’। মূল বইয়ের চেয়ে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে আসফাক আহমেদ আরো এগিয়ে গিয়েছেন।

৩। জাপান কাহিনী (আশির আহমেদ)
বাঙ্গালীদের মধ্যে, বিশেষ করে বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল । কুসংস্কারটা হচ্ছে- সাগর পাড়ি দিয়ে কেউ অন্য দেশে গেলে অমঙ্গল হবে । এই কারনে বাংগালীরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইতো না । ১৮৩১ সালে রাজা রামমোহন রায় এই কুসংস্কার ভেঙ্গে ইংল্যান্ডে যান । তার দেখানো পথ ধরে অনেক বাংগালী পরে জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে গেছেন । অনেকে তাদের বিদেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন,যেটা বাংলা ভ্রমন কাহিনীকে সমৃদ্ধ করেছে ।

Image may contain: text

১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আইন বিষয়ে লেখাপড়া করার জন্য ইংল্যান্ডে যান । পরবর্তী সময়ে তিনি আরো অনেক দেশ ভ্রমন করেছেন । এই ভ্রমনের অভিজ্ঞতা তিনি লিখে গেছেন য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯) নামক বই গুলাতে ।

ব্রিটিশ সরকার সকল আইসিএস অফিসারকে (সেই সময়কার বিসিএস ক্যাডার) ইংল্যান্ডে পাঠাতো ট্রেনিং এর জন্য । অন্য অফিসাররা জাস্ট ট্রেনিং নিয়েই ফিরে আসতো । কিন্তু ১৯২৭ ব্যাচের আইসিএস অফিসার অন্নদাশংকর রায় তার অভিজ্ঞতা লিখে রাখলেন পথে প্রবাসে নামক বইটায় । এই বই এর একটি প্রবন্ধ ‘পারী’ আমাদের এসএসসি পর্যায়ের বাংলা বইতে ছিল ।

বাংলা ভ্রমন কাহিনী সবচেয়ে বেশী সমৃদ্ধ করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী । ১৯২৬ সালে দর্শন পড়ার জন্য গিয়েছিলেন জার্মানিতে । ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালে আফগানিস্তানে কাবুল কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে অধ্যাপনা করেন । ১৯৩৪ -১৯৩৫ সালে তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেন । প্রতিটা দেশ নিয়েই তার ভ্রমন কাহিনী রয়েছে । সবচেয়ে পপুলার বই এর নাম দেশে বিদেশে ।

বর্তমানের জনপ্রিয় ২ কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এবং তার ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল–২ জনেই আমেরিকায় লেখাপড়া করেছেন , এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমেরিকা ঘুরতে গেছেন । আমেরিকা ভ্রমন নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন মে ফ্লাওয়ার , হোটেল গ্রেভার ইন ,নক্ষত্রের রাত(উপন্যাস), নিউ ইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ,ইত্যাদি । মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন , আমেরিকা এবং দেশের বাইরে দেশ ।

তবে এই সকল সাহিত্যিকের দৃষ্টি ছিল পশ্চিমে । ইউরোপ (ইংল্যান্ড ,জার্মানি,ফ্রান্স,রাশিয়া অন্যান্য) আমেরিকা,আফ্রিকা (মিশর) আফগানিস্তান–সব দেশই আমাদের পশ্চিমে । সবার ঝোক ছিল পশ্চিমে যাওয়ার । পূর্ব দিকে ,চীন জাপান মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরে কেউ বোধ হয় যেতে চাইতো না ,অথবা গেলেও সেটা নিয়ে ভ্রমন কাহিনী লিখতো না । রবীন্দ্রনাথ জাপান ডায়েরী লিখেছেন , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মায়ানমার যাওয়ার অভিজ্ঞতা লিখেছেন শ্রীকান্ত নামক বইতে । কিন্তু এগুলো উল্লেখ করার মত কিছু নয় ।

বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতা বোধ হয় পূরন হতে চলেছে । আশির আহমেদ ১৯৮৮ সালে জাপান সরকারের স্কলারশিপ পান । তখন বুয়েটের লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই জাপানে পাড়ি জমান তিনি । লেখাপড়া শেষে তিনি জাপানেই সেটেল করেন । বর্তমানে তিনি জাপানের কিয়ুশু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর । গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন জাপান কাহিনী ১,২,৩ এবং ৪ । বই এর চ্যাপ্টারগুলো অনলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে । (https://www.facebook.com/japan.kahini)

৪। ইনসাইড র (অশোক রায়না)
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research & Analysis wing (RAW) কে নিয়ে সাংবাদিক অশোক রায়নার অনুসন্ধানী বই -ইনসাইড র। ক্লাসিকাল গোয়েন্দাবৃত্তির অনেক তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে বইয়ের শুরুতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৪৭ এর পরে ভারতে র এর প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরন দেওয়া হয়েছে । সবশেষে র এর কয়েকটি সফল অপারেশনের বর্ননা দেওয়া হয়েছে (যেমন-১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধ, ১৯৭৫ সালে স্বাধীন সিকিমকে ভারতের রাজ্যে পরিনত করা, ভারতের পারমানবিক বোমার সফল পরীক্ষা ইত্যাদি)।

No automatic alt text available.

তবে যেসব অপারেশন র ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলো এড়িয়ে গিয়েছেন লেখক এখানে। শ্রীলংকার তামিল-সিংহল গৃহযুদ্ধের কোনো উল্লেখ এখানে করা হয়নি (অনুমান করা হয়, র তামিল গেরিলা যোদ্ধা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরনকে সাপোর্ট দিত শ্রীলংকা থেকে বের হয়ে তামিলদের জন্য আরেকটা স্বাধীন দেশ বানাতে) । খুলনা,বরিশাল,ফরিদপুর নিয়ে স্বাধীন ‘বঙ্গভূমি’ নামক দেশ গঠন করা, পাহাড়ে আদিবাসীদের সাথে যোগাযোগ করে সেভেন সিস্টার্স এর জঙ্গীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী এবং মুক্তিযুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর ভূমিকা–ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব কম।

টপ টেনে এই বইটাকে জায়গা দেওয়ার সময় প্রায় একই ধরনের আরেকটি বই জোর প্রতিযোগিতা করেছিল। সেই বইটা হচ্ছে সাবেক রাশিয়ান গুপ্তচর স্তানিস্লাভ লেভচেংকোর ‘ On the wrong side-My life in KGB (আমি ছিলাম কেজিবির লোক নামে বাংলায় অনুদিত হয়েছে)

৫। মুজিববাহিনী থেকে গনবাহিনী-ইতিহাসের পুনর্পাঠ (আলতাফ পারভেজ)

আলতাফ পারভেজের লেখার বড় সুবিধা হচ্ছে, তিনি প্রচুর তথ্য ইন্টারনেট থেকে কালেক্ট করেন। অন্যান্য লেখকের বইয়ের ফুটনোটে যেখানে অনেক বই/জার্নালের রেফারেন্স থাকে, সেখানে আলতাফ পারভেজের বইয়ের ফুটনোটে কাগজে্র বইয়ের পাশাপাশি উইকিপিডিয়া,ইউটিউব বা অন্যান্য ওয়েবসাইটের লিংক থাকে , যে লিংক মোবাইলে টাইপ করে পাঠক ইন্সটান্টলি সেই তথ্যটা চেক করে নিতে পারে।

এই বইয়ে লেখক একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন । ৬০ এর দশকের শুরুতে এই গোষ্ঠী ছাত্রলীগের অভ্যন্তর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করার জন্য এক ধরনের মুভমেন্ট শুরু করে। কালক্রমে এদের ভেতর থেকেই যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনী তৈরি হয় । রেগুলার মুক্তিবাহিনীর বাইরে লং টার্ম যুদ্ধের প্রিপারেশনের জন্য মুজিববাহিনীও তৈরি হয় এদের ভেতর থেকে । স্বাধীনতার পরে ছাত্রলীগ,যুবলীগ , জাসদ ছাত্রলীগ,জাসদ কিংবা জাসদ এর সশস্ত্র গনবাহিনীর কেন্দ্রীয় পর্যায়েও দেখা যায় এদের কর্তৃত্ব । ওই সময়ে সেনাবাহিনী,মুক্তিবাহিনী আর আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়ে একটি বিশেষ আধাসামরিক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল , যাদের দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দেশের বিভিন্নভাবে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি রক্ষা করা । (আল্টিমেটলি দেখা গেল, এই বাহিনী বিরোধি দলের কর্মীদের নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে) এই রক্ষীবাহিনীর নের্তৃত্বেও দেখা গেল পুরনো মুজিববাহিনীর লোকেরাই।

No automatic alt text available.

লেখক একটি বিশাল ক্যানভাসে পরস্পরের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ১৯৬০ আর ১৯৭০ এর দশক বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হলেও ২০০২ এর জাপান ওয়ার্ল্ড কাপ পর্যন্ত বইয়ের আলোচনায় প্রাসংগিকভাবে এসেছে ।

৬। স্পার্টাকাস (হাওয়ার্ড ফাস্ট)
খৃষ্টপূর্ব ৭১ সাল । রোমান সাম্রাজ্যে গ্লাডিয়েটর দের দিয়ে কুস্তি খেলাটা বেশ জনপ্রিয় । খেলার নিয়ম খুব সিম্পল। ২ জন গ্লাডিয়েটর (যোদ্ধা/খেলোয়াড়) রিং এ নামবেন যুদ্ধ করতে । যে বেচে থাকবে সে বিজয়ী,যে মারা যাবে সে পরাজিত। ভাল গ্লাডিয়েটরদের খেলা দর্শক দেখতে চায়,কিন্তু প্রতিটা খেলায় যেহেতু একজন মারা যাবে সেহেতু এই খেলায় দক্ষ খেলোয়াড় কমে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। কয়েকটা ক্লাবের কোচ তখন নিয়মকানুন চেঞ্জ করল। দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য গ্লাডিয়েটরদের দিয়ে পাতানো খেলার ব্যবস্থা করল ।( সমসাময়িক কালের রেসলিং এর কথা তুলনা করুন। ইউএফসি রেসলিং এ সবাই সত্যিকারের মাইরপিট করে, ফলে খেলোয়াড়রা অনেক বেশি আহত হয়। একারনে মাসে ১টা/২টা ম্যাচের বেশি করা যায়না। অন্যদিকে WWE রেসলিং পাতানো খেলা। খেলোয়াড়রা স্টেজ ড্রামা স্টাইলে দর্শকদের সামনে মাইরপিটের অভিনয় করেন । এ কারনে তারা আহত হয় অনেক কম। মাসে বা সপ্তাহে অনেক বেশি ম্যাচ খেলতে পারেন তারা)।

Image may contain: one or more people and text

ক্লাব মালিকের ইচ্ছার উপর নির্ভর করত ম্যাচের জয় পরাজয় এমনকি গ্লাডিয়েটরদের জীবন মরন । স্পার্টাকাস নামক একজন ক্রীতদাস গ্লাডিয়েটর এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল । তার ক্লাবের সকল গ্লাডিয়েটর দের নিয়ে তিনি নিজের ক্লাবের মালিকদেরকে খুন করে রাস্তায় বেরিয়ে আসলেন । তার বিদ্রোহে ইন্সপায়ার্ড হয়ে অন্যান্য ক্লাব থেকেও গ্লাডিয়েটররা বিদ্রহ করল । এক সময় পুরা রোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ ক্রীতদাস এই ‘ক্রীতদাস বিদ্রোহে’ যোগ দিল । (এই থিমকে কাজে লাগিয়ে ২০১১ সালে WWE Wrestling এ ৭ জন রেসলার বিদ্রোহ করেছিল । তারা রেসলিং এর ম্যানেজমেন্ট এবং প্রধান রেসলারদের উপর আক্রমন করত । এই বিদ্রোহী রেসলারদের দলের নাম ছিল Nexus,ক্যাপ্টেনের নাম ছিল wade barret)

রোমান সাম্রাজ্য এই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করল । হাজার হাজার বিদ্রহীকে ক্রুসিফাই করা হল। (তখন ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে ক্রুসবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত । যীশুকেও এইভাবে ক্রুসবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল) বিদ্রোহীদের ক্রুসিফাইড বডি মাসের পর মাস রাস্তায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল মানুষদের মনে ভয় তৈরি করার জন্য। কয়েক বছর ধরে এই বিদ্রোহ চলার পরে খৃষ্টপূর্ব ৭১ সালে বিদ্রোহিদের নেতা স্পার্তাকাস কে ক্রুসিফাই করার মাধ্যমে বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

স্পার্টাকাস নামে সিনেমা এবং টিভি সিরিয়াল তৈরি হয়েছে । তবে সেখানে সেক্স এবং ভায়োলেন্সের পরিমান অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে মোস্তফা সারয়ার ফারুকী ‘স্পার্টাকাস ৭১’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শর্টফিল্ম বানিয়েছেন।

৭। মাই লাইফ ইন মাফিয়া ( ভিনসেন্ট তেরেসা )
ইটালির কিছু ছিচকে চোরের দল (নাম-মাফিয়া) এর প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেড়েছিল । সরকারী আইন কানুনের কোন তোয়াক্কা তারা করত না । স্বৈরশাসক মুসোলিনি এদের ব্যাপারে কঠোর হলেন। ফলস্বরুপ অনেক মাফিয়া গডফাদার ফ্যামিলি এবং চ্যালাচামুন্ডা (মাফিয়া ফ্যামিলি) নিয়ে জাহাজে করে পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। আমেরিকার অপরাধ জগতে জাকিয়ে বসলেন। ইটালির চেয়ে আমেরিকায় তাদের নতুন সাম্রাজ্যটা হল আরো বড়।

সেনাবাহিনী,পুলিশ প্রশাসন,বিচার বিভাগ,ইউনিভার্সিটি,মিডিয়া–সব জায়গায় তারা নিজেদের লোক ঢুকালো। কাউকে ঢুকানো হল টাকা দিয়ে । অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে স্কলারশিপ দিয়ে বা অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে মাফিয়া ফ্যামিলি নিজেদের অনুগত করেছিল । এই বাচ্চাগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে গেলে মাফিয়া ফ্যামিলি এদেরকে ব্যবহার করবে । এভাবে বিভিন্ন স্ট্রাটেজিকাল পয়েন্টে নিজেদের লোক থাকার কারনে খুব কম সময়েই এরা ধরা পড়তো কিংবা বিচার হত । নিজেদের অদ্ভূত লাইফস্টাইল এবং দর্শনের কারনে বাইরের কারো পক্ষে সংগঠনের ভিতরের কথা জানা খুব একটা সম্ভব হত না ।

Image may contain: text

ভিনসেন্ট তেরেসা নিউইয়র্ক ভিত্তিক একজন গডফাদারের অধীনে কাজ করতেন । দীর্ঘদিন অপরাধ জগতে থাকার পরে এক শুভদিনে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাফিয়াদের কালচার (ওমের্তা) অনুযায়ী ধরা পড়ার পরে কখনোই কোনো ইনফর্মেশন পুলিশকে দেওয়া যাবেনা । কিন্তু ভিনসেন্ট ওমের্তা ভংগ করে পুলিশকে এবং বিশ্ববাসীকে মাফিয়া সাম্রাজ্যের স্বরুপ বর্ননা করেছেন।

মারিয়ো পুজোর গডফাদার এর সাথে এই বইয়ের একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে– গডফাদার নামক ফিকশনে ঘুরেফিরে অল্প কয়েকটা ক্যারেক্টার রয়েছে । অথচ মাই লাইফ ইন মাফিয়াতে দেখা যায় শত শত (কিংবা হাজারের উপরে) ক্যারেক্টার। অলমোস্ট প্রতিটা ক্রাইমের জন্যই আলাদা আলাদা সেটআপ । ফিকশনের চেয়ে বাস্তবে অনেক বেশি মানুশজ জড়িত থাকে একেকটা অপারেশনে।

৮। বিবাহ ও নৈতিকতা-বার্ট্রান্ড রাসেল
বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ছেলেদের নাম রেখেছিলেন ততকালীন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ফিগারদের নাম অনুসারে । যেমন শেখ কামাল এর নাম রেখেছিলেন তুরস্কের জাতীয় বীর মোস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক এর নাম অনুসারে। শেখ জামাল এর নাম রেখেছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের এর নামে । শেখ রাসেল এর নাম রেখেছিলেন আমেরিকান দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এর নাম অনুসারে। অনুমান করা যায়, এই দার্শনিকের লেখা বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

বিডিএসএফ এর স্লোগান হচ্ছে–বাংলাদেশের চোখে বিশ্ব দেখি। এই দেখার পয়েন্ট অফ ভিউ যত বেশি হবে, জিনিসটা সম্পর্কে তত বেশি আমরা জানতে পারব। ইতিহাস,দর্শন,সমাজ,সংস্কৃতি,ধর্ম,রাজনীতি –ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা যত তথ্যই গ্যাদার করিনা কেন,সেগুলা একজন পুরুষ যেভাবে এনালাইসিস করবে , একজন নারীর এনালাইসিস তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। আল্টিমেটলি একজন পুরুষ এবং নারীর আলাদা আলাদা পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে চিন্তা করলেই আমরা কমপ্লিট এনালাইসিস পাব। এ কারনে রাসেল প্রেম করার ( অথবা বিপরীত লিংগের কারো সাথে মানসিকভাবে ক্লোজ হওয়ার) উপরে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন ।

Image may contain: text

সমাজ বা রাষ্ট্রেও নারী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে তার কিছু আনকমন আইডিয়া ছিল । যেমন তিনি বলেছেন,রাষ্ট্রের দরকার সন্তান। যে কাপল কোনো সন্তান দিতে পারছে না, তাদের ডিভোর্স করা উচিত। সন্তানবিহীন পরিবার কন্টিনিউ করার চেয়ে নতুন কারো সাথে সংসার করে সন্তান উতপাদন করা উচিত।

সন্তান লালনপালনকে তিনি একটি প্রফেশন হিসেবে দেখেছেন । একারনে যেসব মেয়ে চাকরি না করে সংসারে সন্তানকে দেখাশোনা করছে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদেরকে তিনি বেতন দেওয়ার দাবি করেছেন । রেগুলার চাকরির পরেও কোন মা যতদিন মার্তৃত্বকালীন ছুটি নিচ্ছে, ততদিন সরকারীভাবে তাকে সাপোর্ট দেওয়ার দাবি করেছেন তিনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমসাময়িক দার্শনিক হয়েও তার চিন্তাভাবনা ছিল সেই যুগের চেয়ে অনেক এডভান্সড । অনেক দেশই এখন তার গাইডলাইন অনুসরন করে বাচ্চাদেরকে স্কুলে সেক্স এডুকেশন দিচ্ছে, ম্যাটার্নিটি লিভ এর ক্ষেত্রে অনেক রকম সাপোর্ট দিচ্ছে কিংবা নিম্ন জনসংখ্যার দেশগুলোতে কাপলদেরকে বেশি বেশি সন্তান নিতে উতসাহিত করছে।

৯। মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি+মেন এগেইন্সট দ্য সি+ পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড (চার্লস নর্ডহফ+জেমস নরমান হিল)
ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে লেখা এই ৩টা বই বাউন্টি ট্রিলজি নামে পরিচিত । ১৭৮৭ সালে বাউন্টি নামে একটি জাহাজ ইংল্যান্ড থেক যাত্রা শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ তাহিতির উদ্দেশ্যে । জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম ছিল উইলিয়াম ব্লিগ। তাহিতি থেকে ফিরতি যাত্রায় ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার কিছুদিন পরেই জাহাজের খালাসি ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান এবং অন্যান্য কয়েকজন ক্রু ক্যাপ্টেন ব্লিগ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্লিগ এবং তার সমর্থকদের একটি ছোট নৌকায় নামিয়ে খোলা সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয় । ক্রিশ্চিয়ানরা জাহাজ নিয়ে তাহিতিতে ফিরে যায়, সেখানেই তারা সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার প্লান করে।

এদিকে ক্যাপ্টেন ব্লিগ ছোট নৌকা নিয়ে বিশাল সমুদ্রের সাথে সংগ্রাম করে অদম্য মনোবল নিয়ে সাগর জয় করে ফেললেন । ১৭৯০ সালে তিনি ইংল্যান্ডে পৌছুলেন। সবকিছু জানার পরে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী বিদ্রোহীদের এরেস্ট করার জন্য তাহিতি রওনা হল ।

Image may contain: 1 person, smiling, text

এদিকে ক্রিশ্চিয়ানের দলের ভিতরেও গ্যাঞ্জাম লেগে গেছে। ইংল্যান্ড থেকে পুলিশ আসতে পারে–এই ধারনা থেকে অনেকে তাহিতি দ্বীপে থাকতে চাইছিল না । অনেকেই আশেপাশের দ্বীপে পালিয়ে গিয়েছিল । সবচেয়ে বড় অংশটা পালিয়েছিল নিউজিল্যান্ডের পাশে ছোট একটা দ্বীপ- পিটকেয়ার্নস আইল্যান্ড এ। পুলিশ এসে তাহিতি দ্বীপ থেকে ১৪ জন বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করল,কিন্তু পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড তারা খুজে পেলনা ।

পিটকেয়ার্ন্স এ অন্যরকম এক সমাজ গড়ে উঠেছিল। ইংলিশ ছেলেদের সাথে তাহিতি থেকে স্থানীয় পলিনেশিয়ান ছেলে এবং কিছু পলিনেশিয়ান মেয়েও এসেছিল নতুন দ্বীপে। এর বাইরে পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড ছিল একেবারেই জনশূন্য । দ্বীপের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম, উর্বর মাটিতে খাওয়া দাওয়ারও অভাব নেই ; কিন্তু ছেলেদের তুলনায় দ্বীপে মেয়েদের সংখ্যা ছিল কম। ফলে বাসিন্দাদের পক্ষে সূস্থ স্বাভাবিক যৌন জীবন চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। ১৭৯৩ সালে দ্বীপের বাসিন্দারা এক দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। প্রচুর রক্তপাতের পর দেখা যায়, জন এডামস এবং নেড ইয়ং নামের দুই ছেলে এবং প্রচুর মেয়ে বেচে আছে । দ্বীপের বংশবৃদ্ধির জন্য তখন প্রচলিত সামাজিক সব নিয়ম নীতি শিথিল করতে হয়েছিল । ১৭৯৯ সালে নেড ইয়ং মারা যায় যক্ষায়। তারপর থেকে জন এডামস তার ‘হারেম’ নিয়ে দ্বীপে একাই বেচে ছিল । ১৮০৮ সালে আমেরিকান একটি জাহাজ পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড আবিষ্কার করে । জন আইল্যান্ড এর গল্প তখন মানুষ জানতে পারে।

ইংল্যান্ডের আদালত জন এডামস এর বিদ্রোহ এবং পিটকেয়ার্ন দ্বীপে তার অস্বাভাবিক সারভাইভাল ইতিহাস জানার পরে তাকে সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করে।

এই ঘটনা নিয়ে ট্রিলজি উপন্যাস লিখেছেন চার্লস নর্ডহফ আর জেমস নরমান হিল। মিউটিনি ইন বাউন্টি বইটিতে বিদ্রোহ ,তাহিতিতে অবস্থান এবং ১৭৯৩ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে বিচারের ঘটনা বর্নিত হয়েছে। মেন এগেইন্সট দ্য সি বইটায় ক্যাপ্টেন ব্লিগ এর সাগর পাড়ি দেওয়ার গল্প বর্নিত হয়েছে । আর পিটকেয়ার্ন্স আইল্যান্ড বইয়ে জন এডামস এর দ্বীপের গল্প বর্নিত হয়েছে।

পিটকেয়ার্ন আইল্যান্ড বর্তমানে ব্রিটিশ শাসনের অধিনে। দ্বীপের জনসংখ্যা ৫০,যাদের অধিকাংশই জন এডামস এর উত্তরসূরি।

১০। মিসির আলি (হুমায়ুন আহমেদ)
হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র মিসির আলি। ঢাকা ভার্সিটির সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর হচ্ছেন মিসির আলি। তার কাছে অনেক জটিল রহস্যময় সমস্যা আসে। তিনি নিজের অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে সেগুলো সল্ভ করেন। অধিকাংশ সমস্যাই রোগীর মানসিক , তবে এর সাথে মাঝে মাঝে ক্রাইম এর ও কিছু সংযোগ থাকে।

No automatic alt text available.

মিসির আলিকে নিয়ে মোট ২২টা উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ। তবে এগুলার মাঝে কোন কোন বইতে তিনি অবৈজ্ঞানিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। টেলিপ্যাথি,হিপনোটিজম,প্যারালাল ওয়ার্ল্ড,ইএসপি পাওয়ার —ইত্যাদি ফেনোমেনন দেখা যায় তার অনেকগুলো বইতে,যেগুলো বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত নয়। বৃহন্নলা ,মিসির আলির অমীমাংসীত রহস্য , আমি এবং আমরা, তন্দ্রাবিলাস,আমি ই মিসির আলি,কহেন কবি কালিদাস,হরতন ইস্কাপন,মিসির আলির চশমা, যখন নামিবে আধার–এই ৯টা বই বিজ্ঞানের সব সূত্র মেনে চলে। এছাড়া ভয় এবং মিসির আলি আনসল্ভড নামে মিসির আলির আরো ২ টা ছোট গল্পের কালেকশন আছে। এই ২ টা বইয়ে কিছু গল্প বিজ্ঞানসম্মত আর কিছু গল্প ভুয়া।

The post আপনার পড়া সেরা ১০টি বই কী কী? appeared first on Bangladesh Study Forum.

সাদা আর কালো নয়, ধরো ধূসর পথ

$
0
0

সাদা আর কালো নয়, ধরো ধূসর পথ

-তাজ উল-ইসলাম হাশমী

 

এতো রং থাকতে কেন তোমার ভুবন
রংশূণ্য, বর্ণহীন, বিবর্ণ, উদাস? লাল-নীল
গোলাপি-হলুদ, বেগুনি — কাঁচা আমলকি
লাউয়ের ডগা বা পাকা কামরাঙ্গার রং
শিমুল ও পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার লালিমা কোথা?

হৈমন্তী স্বর্ণাভ ধানক্ষেতে রং খুঁজে পাওনা তুমি!
অবাক লাগে, গাংশালিকের ঠোঁট, কাঠগোলাপের
বিচিত্র সব রং, মাধবীলতার লাজরাঙ্গা আভা
বাবুই পাখিরা রোদেপোড়া কাঞ্চন
এতবার নিয়ে এলো ওরা, তোমার কাছে
তবুও সাদা আর কালো ছাড়া অন্য রং দেখোনা তুমি,
অবাক লাগে আমার কাছে!

বৈপরীত্ব ভালো লাগে তোমার, সে আমার আছে
জানা
আমিও ভালোবাসি রাতের পর দিন, ভোরের আলো,
সাঁঝের মায়া,
আমিও ভালোবাসি কালো মেঘের মাঝে
বিজুলি ছটা
সঞ্জীবিত করে নিভৃতে লালিত আমার
সুপ্ত গোপন ইচ্ছেগুলো
তাই বলে তুমি দেখবে শুধুই সাদা আর কালো!
মঙ্গলময়, আনন্দময়ী, চিত্ত হরণকারী সব সাদা!
অশুভ, দুঃখপ্রদক, কুৎসিত যা কিছু সব কালো?

আঁধারের আছে রূপ, গুন্ আছে অগুনির,
গন্ধহীন পুষ্প সৌরভহীন নয় সদা
তাকি জানো? শুভ নয় সব সাদা
নয় মঙ্গলময় চিত্ত হরণকারী
তুন্দ্রাঞ্চলের তুষার সাদা
সাদা মোড়কের মাঝে থাকে
সদ্য প্রসূত মৃত সন্তান, বাবার লাশ
মায়ের নিথর দেহ

তাই বলি সাদা-কালোর মাপকাঠি ছাড়ো
ধরো ধূসর বন্ধুর পথ যেটা মসৃন নয় সবখানে
তবে বড্ডো সোজা পথ
পথ হারাবার সম্ভাবনা বড্ডো কম
এই পথে

The post সাদা আর কালো নয়, ধরো ধূসর পথ appeared first on Bangladesh Study Forum.

ছফার গাভী বিত্তান্তে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি

$
0
0

বইঃ গাভী বিত্তান্ত
লেখকঃ আহমদ ছফা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১২০

Image result for গাভী বিত্তান্ত

যারা আহমদ ছফার বই বা লেখা ইতোপূর্বে পড়েছেন তারা জানেন তার লেখনি কত তীক্ষ্ণ। জীবনবোধের গভীরতম প্রকাশ তার রচনাগুলো। ‘অর্ধেক মানবী অর্ধেক ইশ্বরী ‘ দিয়ে আহমদ ছফার লেখনির সাথে পরিচয় হয় আমার। এই বইয়ের নাম দেখে ভেবেছিলাম নিশ্চয় এতে গরু নিয়েই বেশি লিখা হয়েছে! কিন্তু পড়তে গিয়ে নামকরণের যথার্থতা অনুভব করেছি। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানা অসঙ্গতি-শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে লেখা বই গাভী বিত্তান্ত। আমাদের সমাজে এমন কিছু বিষয় আছে যা অপ্রকাশিত, কিন্তু সকলেই জানে। লেখক সেই অপ্রকাশিত বিষয়গুলোকে সাহিত্য রূপ দিয়েছেন। বইটি পড়ে অনুভব করেছি লেখকের চিন্তাশক্তি  কতটা গভীর।  খুব জটিল এবং ভারী কিছু বিষয়কে তিনি রম্যতার গুণে হালকা ও উপভোগ্য করে তুলেছেন।

বইয়ের কাহিনী শুরু হয় সদ্য উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মিঞা মুহাম্মদ আবু জুনায়েদকে নিয়ে। একেবারেই গোবেচারা ও নির্ভেজাল একজন মানুষ হঠাৎ করে কিভাবে এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তা সকলের কাছেই আশ্চর্যের। জীবন প্রবাহের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে সহজে উপাচার্য পদে আসীন হলেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবু জুনায়েদ তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। উপাচার্য হওয়ার আগে আবু জুনায়েদ ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। নির্ঝঞ্ঝাট ও মিনমিনে স্বভাবের লোকটি শুধুমাত্র কাঁচাবাজারেই তার পৌরুষত্ব দেখাতেন। স্ত্রীর বাপের টাকায় লেখাপড়া করেছেন বলে স্ত্রীর কাছে সকাল-বিকাল খোটা শুনতে হত। কৃষক পরিবারের সন্তান আবু জুনায়েদ ব্যক্তি হিসেবে সাধারণ। শুধু জমি কেনার বিষয়ে তার আকাঙ্খা ছিল নেশার মতো।

আবু জুনায়েদকে ঘিরে লেখক অবতারণা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলের দৈনন্দিন ঘটনা। সাধারণ দৃষ্টিতে বইটি রম্য বলে মনে হলেও পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে গভীর বেদনা কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সিন্ডিকেট, টেন্ডার সবকিছু পরিচালিত হয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ছত্রছায়ায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের মেরুদন্ডই যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রের অবস্থা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষক রাজনীতির দুষ্টচক্রে উপাচার্য নির্বাচনের প্যানেলে নাম আসে আবু জুনায়েদের। নিজ ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষিকা দিলরুবা খানমের চালে ভাগ্যচক্রে উপাচার্য কর্তৃক নিয়োগ পান তিনি। সকল ক্ষমতার উৎস হয়ে পদে পদে সম্মুখীন হন নানা  তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বাঁধার। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির বিড়ম্বনা কবিতার মতো আবু জুনায়েদ পড়েন দায়িত্বের বিড়ম্বনায়। উপাচার্য ভবনে ওঠার প্রথম দিন থেকেই আবু জুনায়েদ ও তার স্ত্রীর মধ্যে কাজ করে মধ্যবিত্ত দ্বন্দ্ব। সে পোশাক আর স্যুট টাই দিয়ে দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করত আর তার স্ত্রী সারাবাড়িতে  কর্তৃত্ব প্রকাশের চেষ্টা করতেন।

উপাচার্য ভবনের বিশাল আঙিনা দেখে আবু জুনায়েদের একটি সাধ পূরণের ইচ্ছা জাগে। পূর্বে কোয়ার্টারে থাকায় গাভী পালনের আজন্ম লালিত ইচ্ছেটি অপূর্ণ রয়ে যায় তার। আবু জুনায়েদ ছোটবেলায় বরাবর ভাল ফলাফল করতেন। প্রতিদিন বিকালে খাওয়া এক গ্লাস গরম দুধকেই এমন ফলাফলের কারণ মনে হত তার।

উপাচার্য পদে যোগদানের পর প্রতি শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস হয় আবু জুনায়েদের। এর পিছনে অবশ্য একটা উদ্দেশ্য আছে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের  জনমতের হাওয়া কোনদিকে বইছে তার পূর্বাভাস পাওয়া যায় এখান থেকে।

ঘটনাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার তবারক আলীর সাথে পরিচয় হয় আবু জুনায়েদের। তার শ্বশুরের হাত ধরেই তবারক আলীর আজকের অবস্থান। যার কারনে তবারক আলী আজও কৃতজ্ঞ। সপরিবারে তবারক আলীর বাড়িতে দাওয়াতে গেলে নিজের গরু পোষার ইচ্ছার কথা জানান আবু জুনায়েদ। তবারক আলী দায়িত্ব নিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করেন। লাল রংয়ের অপূর্ব সুন্দর একটি গরু উপহার দেন তবারক আলী। ছিপ নৌকার মতো লম্বা শরীরের গরুটির নাম তরণী।  সবচেয়ে সুন্দর তার চোখ দুটি। যা খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে তরুণী নিবাস বা গোয়ালঘরটি আবু জুনায়েদের সবচেয়ে প্রিয় স্থান হয়ে ওঠে। শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সভা,আড্ডা সবই করতেন গোয়ালঘরে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং ফাইলে সই করতেন গোয়ালঘরে বসেই। আহমদ ছফা লিখেছেন “মোগল সম্রাটরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন।” গোয়ালঘরকে কেন্দ্র করেই তার দৈনন্দিন সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতে থাকলো। গোয়ালঘরকে আবু জুনায়েদ আশীর্বাদ মনে করলেও জুনায়েদ সাহেবের স্ত্রী গরুটাকে সতীন বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেন। তরণীর (গরু) কারণে তার স্বামী তাকে উপেক্ষা করছে এমন ভাবনা থেকে তিনি তরণীকে হত্যার চিন্তা করেন। পেশাগত কাজে স্বামী  বাইরে গেলে তরণীর খাদ্যে বিষ মেশান নূর বানু। বাসায় ফিরে তরণীকে অসুস্থ দেখেন আবু জুনায়েদ। ইতোমধ্যে আমেরিকা থেকে আসা বক্তৃতার অফারের কথা স্ত্রীকে জানাতে গেলে নূর বানু জানান তিনিই গাভীটাকে হত্যা করেছেন।

গাভী ও গোয়ালঘরের কাহিনীর অবতারণা করে লেখক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ দৈন্য দশা ও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির নোংরা ও বাজে দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টা সারকাজম মনে হলেও এতে তীক্ষ্ম ভাব রয়েছে। ১৯৯৪ সালের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি রচিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র এখনো একই রকম। প্রায় সবক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে সেটে আছেন। দলীয়  ও রাজনীতিক কুন্দল বর্তমানে নিত্যকার ঘটনা।বইটি সমাজের এসব ত্রুটি আর অসামঞ্জস্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

The post ছফার গাভী বিত্তান্তে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি appeared first on Bangladesh Study Forum.

A Brief History of Time

হকিংয়ের ‘থিওরি অব এভরিথিং’এ এক চুমুক

$
0
0

আজ দিন শুরু করেছিলাম স্টিফেন হকিংয়ের ‘থিওরি অব এভরিথিং’ পড়ার মাধ্যমে। সাতটি লেকচারের সমন্বয়ে গঠিত বইটির সর্বশেষ লেকচার আর্টিকেল হচ্ছে ‘থিওরি অব এভরিথিং’। আগের আর্টিকেলগুলো গত বছর পড়া হয়েছে তাই ঘন্টাদুয়েক সময় বরাদ্ধ করলাম প্রধান এই আর্টিকেলটিতে।

স্টিফেন হকিং এর প্রাণবন্ত আলোচনা বেশ উপভোগ্য। আর্টিকেলটি পড়ে অর্ধেক বুঝেছি আর বাকি অর্ধেক পরবর্তীতে বুঝবো বলে আশা রাখছি। এরকম লেখা পড়ার তাত্পর্য হলো এটি আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনকে সচল করে, সারা জীবনের সকল পঠন পাঠনকে পাশে নিয়ে আসে। সকল অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেয় সহজ ভাষায় লিখিত জটিল কিছু কথাকে অনুধাবন করার চেষ্টায়।

স্টিফেন হকিংয়ের লেখায় অন্যান্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের চিন্তার সারবত্তা খুব সুন্দর করে উঠে আসে। নিউটন, আইনস্টাইন থেকে বিশ শতকের শক্তিমান দার্শনিক ভিৎগেনস্টাইনসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন হকিং। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে তিনি কীভাবে তার পূর্বসুরীদের বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন।

পৃথিবীর সকল কিছুকে কী একটি থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? এ প্রশ্নকে সামনে রেখে হকিং তার আলোচনা আগিয়েছেন। প্রথমদিকেই পূর্বের কোন কোন বিজ্ঞানী এ প্রচেষ্টায় শ্রম দিয়েছেন তাদের কথা বলেছেন, তাদের চেষ্টা, ব্যর্থতা, কাছাকাছি সাফল্যের কথা বলেছেন। আবার সবকিছুকে একই থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কী না সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

কিছু কথা খুব ভালো লেগেছে, চিন্তার দরজায় ধাক্কা দিয়েছে। আর্টিকেলটির এক পর্যায়ে বলেন নিউটনের সময়কালে কেউ ইচ্ছে করলে পৃথিবীর পুরো জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে ভালো পরিচয় নিয়ে আসতে পারতো। রেনেসাঁ যুগে কারো কারো সম্পর্কে এমন কথাও হয় তিনি বা তারা পৃথিবীতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সব বই পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু বর্তমানে জ্ঞানের বিভিন্ন ডিসিপ্লিন এত সম্প্রসারিত হয়েছে সবগুলো ডিসিপ্লিন দূরের কথা কোন একটি বিশেষ ডিসিপ্লিনের উপর দখল রাখা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কারণ খুব দ্রুত সেখানে পরিবর্তন চলে আসছে। বেশ কয়েকটি ডিসিপ্লিনে খুবই প্রাথমিক ধারণা নিয়ে জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা বা উপশাখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে স্কলারদের।

পূর্বে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে ইমানুয়েল কান্টদের মতো রথী মহারথী দার্শনিকরা মনে করতেন জ্ঞানের তাবত্ জগতেই তাদের বিচরণের জায়গা। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এত বেশি উন্নতি ঘটেছে এবং এত বেশি শাখা উপশাখা চলে আসছে এখন যুগটাই হয়ে গিয়েছে ‘স্পেশালিস্টদের’ বা বিশেষজ্ঞদের মানে যারা এক বা সীমিত জ্ঞানকাণ্ডে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন বা অর্জনের চেষ্টায় রয়েছেন।

এজন্য বিজ্ঞানসহ জ্ঞানকাণ্ডের অনেকগুলো বিষয়ে দখল রাখা দার্শনিকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে জার্মান দার্শনিক লুডভিগ ভিৎগেনস্টাইনের একটি কথা আর্টিকেলটির শেষ দিকে উল্লেখ করেছেন হকিং। সেটি হলো: ‘দর্শনের একমাত্র কাজ হয়ে দাড়িয়েছে ভাষা বিশ্লেষণ।’ (The sole remaining task for philosophy is the analysis of language.)

এ কারণেই আমরা দেখি বিশ শতকে সবচেয়ে প্রভাবশালী ডিসিপ্লিন হিসেবে দাড়িয়েছে ভাষাবিজ্ঞান। এবং বিশ শতকের সব প্রভাবশালী দার্শনিকেরই মূল অবদান ভাষাবিজ্ঞানে। আর্টিকেলটি শেষ হয়েছে এক ফাউস্টিয় উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে! ঈশ্বরের পরিকল্পনা জানার দুঃসাহসী সম্ভাবনা নিয়ে! থিওরি অব এভরিথিং এ যদি পৌছা যায় তাহলে যেটি সম্ভব হবে সেদিকে ইশারা দিয়ে হকিং বলেন, ‘If we find the answer to that, it would be the ultimate triumph of human reason. For then we would know the mind of God.’

The post হকিংয়ের ‘থিওরি অব এভরিথিং’ এ এক চুমুক appeared first on Bangladesh Study Forum.

কারাগারের রোজনামচা : ব্যক্তি মুজিবের অন্তরঙ্গ পরিচয়

$
0
0
“স্বাধীনতাকামী মানুষের পরিত্রাতা কে?
সাত কোটি বাঙ্গালীর ভাগ্য বিধাতা কে?
একটি সুরেতে কে দিয়েছে বেঁধে বাঙ্গালীর অন্তর?
সে তো শেখ মুজিব! ধন্য মুজিব!”
১৯৭১ সালে ওপার বাংলার প্রখ্যাত শিল্পী, লেখক ও  ছড়াকার লক্ষীকান্ত রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ গানটি গেয়েছিলেন। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হতো না সেই ধন্য মুজিবের জন্মদিন ১৭ মার্চ। সেদিন টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত এক পল্লীতে এমন একজনের জন্ম হয়েছিল, যার হাত ধরে বাঙালি জাতি দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ২শ’ বছরের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করেছিল; পেয়েছিল স্বাধীনতার স্বাদ, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে এক স্বাধীন- সার্বভৌম ভূ-খণ্ডের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। জাতির জনকের ৯৭ তম জন্মদিনে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয় তার রচিত ২য় বই  কারাগারের রোজনামচা
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পর যে বইটি সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে সেটি হল কারাগারের রোজনামচা। কত কণ্টকাকীর্ণ পথ, কত ষড়যন্ত্র, কত বিশ্বাসঘাতকতা, কত ব্যথা, কত বেদনা, কত রক্তক্ষরণ, কত ক্রান্তিকাল পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি দেশ, একটি জাতীয় পতাকা আমাদেরকে দিয়েছেন; তা অনুধাবন করা যায় তার লেখা কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থটি পাঠ করলে। বাঙালির ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তথা স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য নিজের জীবন-যৌবন উজাড় করে দিয়ে যে মহান আত্মত্যাগের পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তাই এই গ্রন্থের পাতায়-পাতায় পরম মমতায় শব্দে-বাক্যে গ্রথিত আছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। ভাগ্য বিড়ম্বিত বাঙালি অনাহারে থাকে, বাংলার মানুষের মুখে হাসি নাই, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন; সেই ক্রান্তিকালকে মোকাবেলা করে বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার একমাত্র ব্রত। তাইতো তিনি নিজের জন্মদিনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বলেছেন: “আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!” (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা: ২০৯ ; ১৭ই মার্চ ১৯৬৭, শুক্রবার)
১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেবার পর বাঙালি জাতির মহানায়ক গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকেন। সেই সময়ে কারাগারে প্রতিদিন তিনি ডায়েরী লেখা শুরু করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঘটনাবহুল জেল-জীবনচিত্র এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কারাগারের রোজনামচা- গ্রন্থটির নামকরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। বইটির ভূমিকা লেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভূমিকাতে তিনি ২৫ শে মার্চ কাল রাতের পর প্রথমবার খাতা উদ্ধার এবং ১৯৮১ সালে ২য় বার কিভাবে খাতা উদ্ধার করেন সে বিষয়টি লিখেছেন। প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত বইটির ৭০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে।
১৯৬৬ সালের বিখ্যাত থালা বাটি কম্বল জেলখানার সম্বল এই লেখার (গানের) মধ্য দিয়ে কারাগারের রোজনামচা পড়ার সময় জেলখানা সম্পর্কে পাঠকের একটা ধারণা হবে। আর এই লেখা থেকে জেলের জীবনযাপন এবং কয়েদিদের অনেক অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল সেসব কথা জানা যাবে। জেলখানায় সেই যুগে অনেক শব্দ ব্যবহার হতো। এখন অবশ্য সেসব অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তারপরও মানুষ জানতে পারবে বহু অজানা কাহিনি। অন্যদিকে ১৯৬৭ ও ৬৮ সালের রোজনামচায় পারিবারিক জীবন, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, কাছের প্রিয়জনরা  কিভাবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে সেসব বিষয় লিখেন। সমাজের উচুস্তরের মানুষের নিচতলার মানুষকে শোষন করার মানসিকতা কিভাবে একজন সাধারন মানুষকে চোরে পরিনত করে সে বিষয়টিও বাদ যায়নি তার লেখায়।
নিচে কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ন উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো:
দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে রাজনীতি; সেই রাজনীতিতে দ্বিচারিতা ও কপটতা চলে না। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়েও সেখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থই বড়। বঙ্গবন্ধু দেশ ও জনগণের স্বার্থেই রাজনীতি করেছেন। তিনি বলেন, “রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত” (পৃষ্ঠা: ৫৭-৫৮, ২রা জুন ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)। বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে যেমন বীরের জাত বলেছেন, ঠিক তেমনি বাঙালি যে পরশ্রীকাতর সেটিও বলতে ভুলেননি। বাঙালিরা অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়, আবার এই বাঙালিই যে অন্যের ভালো দেখতে পারে না, সেটিও উল্লেখ করেছেন তাঁর দিনলিপিতে।  তিনি লিখেছেন “এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এতো উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা!” ( পৃষ্ঠা: ১১১-১১২, ২০শে জুন ১৯৬৬, সোমবার)। একদিকে ‘৬৬ সালের ভয়াবহ বন্যার ফলে জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। অন্যদিকে ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আওয়ামীলীগসহ সারাদেশের মানুষ সোচ্চার, তখন চলছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না পাকবাহিনীর হাত থেকে। জাতির সেই সংকট কালে কিছু মানুষকে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন বাঙালি জাতির সাথে বেঈমানি করতে। যাদেরকে বঙ্গবন্ধু ‘আগাছা- পরগাছার’ সাথে তুলনা করে লিখেছেন,  “বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। …আজ বিকেলে অনেকগুলি তুললাম” (পৃষ্ঠা: ১১৭, ২৩ জুন ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)
বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যখন জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসতেন, তখন একটু বেশি করে বিভিন্ন পদের খাবার বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধু সেই খাবার শুধু নিজেই খেতেন না, অন্যান্য কয়েদীদেরকে সেসব খাবার বণ্টন করে দিতেন। তিনি সারা জীবন মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজে না খেয়েও অন্য কয়েদিদের নিজের খাবার খেতে দিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শাসন আমলে ধনী-গরীবের ব্যবধান এত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা বঙ্গবন্ধু তার লেখায় উল্লেখ করেছেন: “আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম” (পৃষ্ঠা: ১৮৯, ৪ঠা আগস্ট ১৯৬৬, বৃহস্পতিবার)
এই মহান নেতা যিনি তার পরিবার পরিজন ত্যাগ করেছেন দেশবাসীর জন্য তাকেও মানুষ চোর অববাদ দিতে ভুল করে নি।  তিনি আক্ষেপ করে লিখেন, “এই তো দুনিয়া! জনাব সোহরাওয়ার্দীকে ‘চোর’ বলেছে, হক সাহেবকে ‘চোর’ বলেছে, নেতাজি সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু ‘চিত্তরঞ্জন’কে এই বাঙালিরাই ‘চোর’ বলেছে, দুঃখ করার কি আছে!(পৃষ্ঠা: ১৮৮-১৮৯)
কারাগারে বঙ্গবন্ধুর অবসর কাটত বই পড়ে আর প্রকৃতিকে ভালোবেসে। চমৎকার ভাবে তিনি তার বাগানের বর্ণনা, মুরগির বর্ণনা যেমন লিখেছেন তেমনি তুলে ধরেছেন জুলম-নির্যাতনের পাশাপাশি ৬-দফার আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হয় সে বিষয়টিও ।
আত্মজীবনী লেখা কঠিন কারন সেখানে যেমন নিজের প্রশংসা করলে পাঠক নিবে না ঠিক তেমনি কেউ নিজের ভুলগুলোও লিখতে চান না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সব কিছুর  ঊর্ধ্বে জেলখানায় তার চারপাশের মানুষদের সম্পর্কে লিখেছেন। তাকে কিভাবে জেলখানায় বন্দী করে নির্যাতন করেছে সে বিষয়টি যেমন লিখেছেন, তেমনি একে ফজলুল হক,  মানিক মিয়া সহ দেশপ্রেমি নেতাদের সম্পর্কে লিখেছেন। হাস্যরস,  সাহিত্যগুন কি নেই বইটিতে! মোট কথা ব্যক্তি মুজির অন্তরঙ্গ পরিচয় মিলে এই কারাগারের রোজনামচা বইটিতে।

The post কারাগারের রোজনামচা : ব্যক্তি মুজিবের অন্তরঙ্গ পরিচয় appeared first on Bangladesh Study Forum.


সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’: পাঠানুভূতি

$
0
0

-তানিম ইশতিয়াক

সাবিদিন ইব্রাহিমের অনুবাদে রোমান দার্শনিক সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ পড়ে শেষ করলাম। বহুদিন পরে পড়া আত্মানুসন্ধানমূলক অসাধারণ একটি বই এটি। জীবনকে অর্থপূর্ণ যাপন করা নিয়ে অতি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর ও অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকের উপর আলো ফেলার চক্রাকার চেষ্টা করেছেন সেনেকা। সেই প্রায়শ প্রশ্ন ও ধূসর ধারাভাষ্য এই যে, ‘জীবন এত ছোট কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে অনেক সম্পূরক প্রশ্ন আসে। আমরা যে জীবনকাল পাই, তা কি আসলেই ছোট? কোন জীবনকে বড় বলে? দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে থাকলেই সেটা কি বড় জীবন হয়? আর যাপিত জীবন কতটা নিজের? আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কতটা নিজের জন্য? এসব বহুল কাঙ্খিত বিবিধ ভাবনার বৃত্তাকার ব্যবচ্ছেদ করেছেন এই প্রভাবশালী রোমান দার্শনিক।

অনূদিত এই বইটির শুরুতে দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন অনুবাদক। ঝরঝরে সেই ভূমিকাকে বলতে পারি মূল বইয়ের সহজ সংক্ষেপ ও স্বচ্ছন্দ সম্ভোগ। বইটির মূল ভাবনা বলা যায় দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে, জীবনকে গতানুগতিক ব্যয় করার অর্থ ও তাৎপর্য খতিয়ে দেখা। আর দ্বিতীয় ভাগে জীবনকে ফলবান ও মহিয়ান করে উপভোগ করার উপায়। সেনেকা স্বীকার করতে চান না যে, মানুষকে ছোট জীবন দেওয়া হয়েছে। মানুষ তার একজীবনে যতটা সময় পায়, তার বড় অংশটাই ব্যয় করে বেহুদা কাজে। আরেকটা অংশ ব্যয় করে অন্যের প্রয়োজনে। মানুষ আসলে নিজেকে সময় দেয় না, নিজের জন্য নিজের মতো বাঁচতে পারে না অথবা বাঁচতে জানে না। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, নিজের মালিকানার সামান্য জায়গা জমির মতো বস্তুর কিয়দাংশ অন্য নিতে চাইলে কীভাবে ক্ষেপে উঠি, অথচ সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সময়কে দেদারসে যাকে তাকে বিলিয়ে দেই। অনুবাদকের ভাষায় বলি, ‘অন্যকে সুখী করতে, অন্যের সামনে সুখী হিসেবে নিজেকে সবসময় তুলে ধরতে কত মানুষের জীবনের বড় অংশ চলে যায়। জীবনের যোগ-বিয়োগ শেষে দেখা যায়, আর সবাইকে সুখী করতে পারলেও যাকে সুখী করা হয়নি সেটা হলো নিজেকে। অনেক মানুষের উপর ক্ষমতাবান হওয়াকে অনেকে জীবনের সফলতা মনে করে। এর একটা গোলকধাঁধা হচ্ছে, এই যে অনেকের কাছে পরিচিত হলেও দেখা যায় যে সে নিজের কাছে সবচেয়ে অপরিচিত। এজন্য অনেক খ্যাতিমান লোক দিনশেষে খেয়াল করে ভড়কে যায় যে, নিজের জন্য তার সময় বরাদ্দ কত কম।’ অনেককেই বলতে দেখা যায়, কবে এসব ছেড়ে অবসরে যেতে পারব। আর অবসরে গিয়েই নিজের স্বপ্নের ও সবচেয়ে আকাঙ্খার কাজ করব। সেনেকা স্মরণ করিয়ে দেন সেই অমোঘ সত্য, শেষ বয়সের অবসর সময় পর্যন্ত ওই মানুষটি বাঁচবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই!

সেনেকার সমীকরণ পড়তে শুরু করে এক জায়গায় গিয়ে আমি চমকে উঠি! সেখানে তিনি শতায়ু বুড়োদের ডেকে বলতে চান, একটু হিসাব করে দেখো তো, জীবনের কত সময় কত দিকে কত জন নিয়ে গেল! সেনেকার ভাষায়, ‘স্মৃতির দিকে মুখ ফেরাও। দেখো কোন সময়টাতে তোমার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। কোন দিনগুলো তোমার পরিকল্পনামতো কাটাতে পেরেছো, কোন সময়টার উপর তোমার নিজের নিয়ন্ত্রণ ছিল, কোন সময়টাতে তোমার মুখমণ্ডল প্রসন্ন ছিল, কোন সময়টাতে তুমি অবিচল ছিলে? … কতটুকু সময় উড়িয়ে দিয়েছো অহেতুক দুঃখবিলাস করে, বোকাদের মতো আনন্দবিলাস করে, লোভাতুর আকাঙ্খা নিয়ে, সমাজের প্রলোভনে পড়ে?’

আমার চমকে ওঠার কারণ হলো, নিজের জীবন নিয়ে ঠিক এমনই একটি পর্যালোচনা আমি করেছিলাম অর্ধযুগ আগে। ২০১২ সালে ‘সময়ের সাতকাহন’ নামে একটি নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, “কতটা ভালো সময়ের ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি? কতটা খারাপ সময়ের মুখোমুখি আমি হয়েছি? কিছুটা সময় আমি আকাশ ছিলাম, কিছুটা সময় সংকীর্ণ। কতক সময়ে আমি বাগান হয়েছিলাম, কাঁঠালচাপার ঘ্রাণ ছেড়েছিলাম। আবার কতক সময়ে আমি নর্দমা হয়েছি, দুর্গন্ধের প্রতীক হয়েছি, হিংসা-ক্রোধ-রাগের বাষ্প ছড়িয়েছি। কিছু সময় ছিল চিন্তার, ভাবনার, পরিকল্পনার। কিছুটা আবেগের, কিছুটা স্বেচ্ছাচারের। কিছুটা ভালোবাসার, কিছুটা অভিনয়ের। সময়ের একটা অংশে আমার জীবনে জোনাকি উড়েছিল, তারকা জ্বলেছিল। কখনো কখনো আমি নিজেই জোনাকি হয়েছি, আলো জ্বেলেছি, সময়কে উজ্জ্বল করেছি। এটা করতে আমার কষ্ট হয়েছিল, পরিশ্রম হয়েছিল, বেদনার বাতাসে তবু মাখামাখি করেছিল জোছনা। কোনো কোনো সময়ে আমার মনে মেঘ জমেছিল, আঁঁধার এসেছিল, রাত্রি নেমেছিল, ঝড় উঠেছিল, বন্যা হয়েছিল। আমি নিজেই মেঘ হয়েছি। মেঘ হয়ে ভেসেছি। উড়েছি। রঙিন ঘুড়ির মতো উড়েছি। কোমলতার সন্ধানে ঘুরেছি। উড়েছি আর ভেসেছি। ভাসতে ভাসতে ঝরেছি, কেঁদেছি। সমস্তই আমার সুখ ছিল, সমস্তই আমার অসুখ ছিল। হেসেছি, কেঁদেছি; কেঁপেছি, ভেঙেছি; শিহরিত হয়েছি, নির্বিকার থেকেছি; উল্লসিত হয়েছি, বিমর্ষ হয়েছি; ঝলসে উঠেছি, মুষড়ে পড়েছি, নিজেকে হারিয়েছি, নিজেকে খুঁজেছি। সময়কে ভেঙে ভেঙে, কেটে কেটে, সাঁতরাতে সাঁতরাতে আমি এগিয়েছি। আমাকে ভেঙেছি, ভাঙতে ভাঙতে গড়েছি; আমি ধ্বংস হয়েছি, ধ্বংসের ভেতর থেকে নতুন আমি বের হয়েছি।”

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখি এই পর্যালোচনা আমার ভেতরে তৈরি হয়েছিল, পবিত্র কুরআনের সূরা আসর (সময়) পড়ে। সেখানে আল্লাহ বলছেন, ‘সময়ের কসম! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।’ সেনেকা যেমন সময়কে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলেছেন, এই সূরার তাফসিরে ইমাম রাযী সময়কে মানুষের মূলধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই পর্যায়ে একজন মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন : “একজন বরফওয়ালার কাছে থেকে আমি সূরা আসরের অর্থ বুঝেছি। সে বাজারে জোর গলায় হেঁকে চলছিল, ‘দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পূঁজি গলে যাচ্ছে। দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পূঁজি গলে যাচ্ছে।’ মানুষকে যে আয়ুষ্কাল দেয়া হয়েছে তা বরফ হয়ে যাবার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে । একে যদি নষ্ট করে ফেলা হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতি।

সেনেকা যেসব সমীকরণ মেলাতে বলেছেন, সেই উপলব্ধি আমাদের অনেকেরই হয়। বেশিরভাগেরই হয় শেষ বয়সে, যখন আর শোধরানোর সময় থাকে না। কিন্তু শুরুর দিকেই সেই হিসাব মাথায় থাকলেও আমরা কি নিজের মতো সবকিছু করতে পারি? সেই কৈফিয়ত আমি তখন লিখেছিলাম এভাবে, “নাগরিক জীবনে সময় পাই না সময়কে দেখার। এখানে সময়ের সাথে আকাশের সম্পর্ক নেই, সূর্যের সংস্রব নেই, চাঁদের যোগসূত্র নেই, ঢেউয়ের ছোঁয়া নেই। সময় ঘড়িতে, মোবাইলে, কম্পিউটারে, যন্ত্রে। যন্ত্রের মতো সময় তাই কাঠখোট্টা। সময় আমাকেও নির্জীব করে তোলে, যান্ত্রিক হতে বলে, নীরস হবার মন্ত্র দেয়। আমাকে ছুটতে হয়, চলতে হয়, স্বপ্নের ভেতরেও দৌড়াতে হয়। হাই, হ্যালো, ভালো আছি, কৃত্রিম হাসি, অনুতাপহীন স্যরি, ক্লাস, লেকচার, নোট, পরীক্ষা, অফিস, ঘুম, এলার্ম, দৌড়… আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। নিজেকে আমার অভিনেতা লাগে। আমি সময়োপযোগী নিপুণ অভিনয় করে যাচ্ছি। সময় আমাকে অভিনয় শেখাচ্ছে। কিংবা কে জানে, সময় নিজেই বড় অভিনেত্রী! কিন্তু এভাবে আমি পরি না। আমি ভেঙে পড়ি। আমার ভেতরে ক্ষরণ হয়। সময় আমাকে ক্লান্ত করে, আমি হাঁপিয়ে উঠি, পিছনে পড়ে যাই। আমি জানি- ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ কিন্তু আমার নিজের জন্য এক টুকরো সময় থাকে না। অথচ আমার একটু সময় চাই। একান্ত মুহূর্ত চাই। খুব ব্যক্তিগত ‘জিরো আওয়ার’ চাই। আমি একটু জানালার পাশে বসতে চাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময়কে ছুঁতে চাই। নক্ষত্রের সাথে হাঁটতে চাই। বাতাস মাখতে চাই, জোছনায় ভিজতে চাই, কুয়াশায় জড়াতে চাই। সময় আমাকে সেইটুকু সময় দিতে চায় না। সময় আমাকে দূরে ঠেলে দেয়, আবার সময়ই কাছে না আসার কৈফিয়ত চায়! সময় আমাকে খুব অসময়ে আঘাত করে, নিষ্ঠুরভাবে আহত করে। আমি চিৎকার করতে পারি না, চিৎকার করার সময় পাই না।” আসলে আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা নিজেদের পছন্দের কাজে মগ্ন হতে দেয় না।

এখন সময়কে কাজে লাগাবো কীভাবে?

সেনেকা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় বাতলে দিচ্ছেন। তা হচ্ছে, জ্ঞানের পুরোহিতদের বন্ধু বানানো। তাদের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করা। সঙ্গী হিসেবে যদি জেনো, পিথাগোরাস, ডেমোক্রিটাস, অ্যারিস্টটল, থিওফ্রাসটোসকে গ্রহণ করি, তবে তাদের কাছ থেকে আমরা শূন্য হাতে ফিরব না। এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে দিন রাতের যেকোনো সময় যেকেউ দেখা করতে পারে, তাদের উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। সেনেকার ভাষায়, আমাদের ভাগ্যে কোন বাবা-মা পড়বে, সেটা আমাদের ক্ষমতার মধ্যে নেই। আমরা দৈবক্রমে এটা লাভ করি। তারপরও আমরা কাদের সন্তান হতে চাই, সেটা কিন্তু আমাদের হাতে। আমরা চাইলে মহান চিন্তকদের চিন্তার উত্তরসূরী হতে পারি। তাদের যেকারো সন্তান হতে পারি। আমরা শুধু তাদের নামেরই উত্তরসূরী হবো না, বরং তাদের সম্পদেরও ভাগিদার হবো। সেই সম্পদ আমাদের নীচভাবে প্রহরা দিয়ে রাখতে হবে না। যত মানুষকে বিলিয়ে দেব, ততই বৃদ্ধি পাবে। এটা অমরত্বের পথ খুলে দেবে।”

সেনেকার মতে, অন্য মানুষের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে কিংবা সমাজসেবার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নিজেকে সময় দেওয়া। নিজেকে জানা। জীবনের ভাবাবেগের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে জীবন ও মৃত্যুর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করা। যা কিছু ভালো জানার আছে, করার আছে এই জীবনেই করতে হবে। এই জীবনেই মহৎগুণ ও ভালোবাসার চর্চা করতে হবে। সেনেকা মোটা দাগে যেসব প্রশ্নের উল্লেখ করেছেন তা এই যে, ‘বিশ্বের সারবত্তা কী? আনন্দ কী? জীবন কীভাবে চালাতে হয়, ঈশ্বরের স্বরূপ কেমন, আত্মার জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে? দৈহিক বাঁধন থেকে মুক্তির পর আমাদের আত্মা কোথায় যায়…।

সত্যি কথা হচ্ছে, জীবনের শুরুতে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এসব ভাবনার উপরেই নির্ভর করছে, আমার জীবনটা কোন পথে পরিচালিত হবে। জীবনের মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুনিয়াটা আসলে কী? এখানে মানুষের মর্যাদা কী? দুনিয়াকে মানুষ কীভাবে ভোগ ব্যবহার করবে? কোন চরম উদ্দেশ্যের পেছনে মানুষ ছুটছে?

যদি এই মিমাংসায় আসি যে, এই জীবনটাই শেষ জীবন, মৃত্যুর পরে আর কোনো জীবন নেই। তবে ভোগবাদকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন মনে করায় দোষ দেখি না। আমার যেভাবে ভালো লাগে, সেভাবেই আমার জীবনকে ব্যয় করতে পারি। আমার লক্ষ্য হতে পারে, প্রচুর অর্থবিত্ত কামানো আর তা ভোগ করা। আমার সুখ হতে পারে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ার মধ্য দিয়ে। আমার আনন্দ হতে পারে প্রচুর ক্ষমতা চর্চার মধ্য দিয়ে। আবার হতে পারে অন্যের প্রয়োজনে বিলিয়ে দেয়াই সুখ, সমাজসেবায় অবদান রাখাই মুখ্য, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা মহত্ত্বর। এর কোনোটাতেই সমস্যা হবে না। শুধু নিজের স্বাচ্ছন্দ কোথায় খুঁজে বের করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে এই অ্যারিস্টটল, প্লেটো, পিথাগোরাসদের সঙ্গে সময় কাটানোটা বোরিং মনে হতে পারে, তাদের তত্ত্বীয় ভাববাদ পড়াটা বিরক্তিকর ঠেকতে পারে, জ্ঞানচর্চাটা নীরস ও পানসে হতে পারে, এমন জীবন কাটানো অর্থহীন অপচয়ও মনে হতে পারে। এতেও কোনো দোষ দেখি না। এই ক্ষেত্রে কোন জীবনটা অর্থপূর্ণ ও মহৎ- তা ব্যক্তির অভিরুচি ও উদ্দেশ্য ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তখন সেনেকা বা আমরা কেউই বলতে পারব না, মদে ডুবে থাকা ব্যক্তির জীবন ব্যর্থ হয়েছে, ক্ষমতাধর ব্যক্তির জীবনটা অপচয় হয়েছে!

সেনেকার এই বইটা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সূরা আসরকে উপলব্ধি করার আরেকটা চমৎকার আলোচনা মনে হয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে, আমি বেশ আগেভাগেই মহামানব হযরত মুহাম্মদকে (সা.) আমার শিক্ষক ও বন্ধু বানিয়েছিলাম। আমি যখন তার উপর অবতীর্ণ কুরআন পড়ি, এই দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে চমৎকার আলোচনা পাই। সেখানে বলা হচ্ছে, মানুষ নিজেদের সম্পর্কে সাধারণত দুই রকম ধারণা পোষণ করে। কেউ মনে করে, এই দুনিয়ায় সে-ই সর্বেসর্বা। এই ধারণায় তার মনমস্তিষ্কে অহংকার ও বিদ্রোহ জন্ম নেয়। ফেরাউন শাদ্দাদের মতো সে বলে, মান আশাদ্দু মিন্না কুওয়াতা (আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কে?) অথবা (আনা রব্বুকুমুল আ’লা (আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু)। আবার কেউ কেউ পৃথিবীতে নিজেকে সবচেয়ে নীচ সত্তা মনে করে। তাই সে গাছ-পাথর-আগুন-সূর্য যার কাছেই সামান্য শক্তি দেখে, তার কাছে মাথা নত করে। কুরআন এই দুই ধারণাই বাতিল করে বলছে, “আপন তত্ত্বের প্রতি মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, সে কোন জিনিস থেকে পয়দা হয়েছে? সে পয়দা হয়েছে সবেগে নির্গত এক পানি থেকে যা পিঠ ও বক্ষ অস্থির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে” (সুরা আততারিক : ৫-৭)। এই বাক্য বলে মানুষের অহংকারকে চূর্ণ করেছেন। আবার তার মর্যাদায় বলেছেন, “আমরা বনী আদমকে সম্মান দান করেছি এবং স্থল ও জল পথে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি এবং আমাদের সৃষ্টি করা বহু জিনিসের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি” (সূরা বনী ইসরাঈল-৭০)। “(হে মানুষ!) তুমি কি লক্ষ্য করো না, দুনিয়ায় যা কিছু রয়েছে, আল্লাহ তার সবই তোমাদের জন্যে অধীন করে দিয়েছেন? (সূরা আলহাজ্জ-৬৫)। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বর্ণনা করে তাকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

এখন ফিরে আসি সূরা আসরে। সময়ের কসম করে বলা হচ্ছে, সেসব মানুষ ক্ষতির মধ্যে নেই, যারা চারটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথমত, যারা সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎ কাজ করেছে, অন্যকে সৎ উপদেশ দিয়েছে, এবং ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়েছে। এই লেখায় ব্যাখ্যা বলার সুযোগ নেই। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে এটা বলতে হবে যে, এতে আমার জীবন যাপনটা কেমন হচ্ছে। আমি স্রষ্টায় অনুগত হচ্ছি এবং মানবকল্যাণের অনুভূতি ধারণ করছি, তখন অন্যের কল্যাণে কাজ করা আমার সময় নষ্ট নয়। শান্তিপূর্ণ জনপদ গড়ার জন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন কিংবা সমাজসেবায় আমার জীবন ব্যয় করা মূলত আমার নিজের জন্যই। এমনকী আমার স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়াও আমার বিনিয়োগ। যাকাত বিধানের এক লেখায় পড়েছিলাম, আমাদের অর্থব্যয় মূলত আল্লাহর পথে। ইয়াতিম, বিধবা, অসহায়, বিপদগ্রস্ত এবং নিসম্বল পথিকদের জন্য যা কিছু দান করি, এর প্রতিদান তাদের কাছে আশা করি না। তাই বলে এটা নিঃস্বার্থও না। এর প্রতিদান আল্লাহ দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতএব সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে বা মানুষের উপকারার্থে আমরা যে সময় ও সম্পদ ব্যয় করি, তা মূলত আমার নিজের জন্যই ব্যয় করি। এই বিনিয়োগের বহুগুণ লাভসমেত আমরা ফেরত পাবো। যখন ঈমানের রঙ মেখে আমি আমার জীবন পরিচালনা করি, নামাজ শেষ হলে জনপদে ছড়িয়ে পড়ি, সৎ কাজ করি, অন্যের উপকার করি, ঝঞ্ঝাগ্রস্ত মানুষকে সততায় অটল থাকতে ধৈর্য ধরতে বলি- এভাবে দিন-রাত ব্যয় করি, এই ২৪ ঘণ্টাই মূলত আমার নিজের জন্য ব্যয় করছি। আমার জীবনের পুরোটাই আমি আমাকেই দিচ্ছি।

বই : অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ

লেখক : লুকিউস আন্নাইউস সেনেকা

অনুবাদ : সাবিদিন ইব্রাহিম

প্রকাশনী : ঐতিহ্য

মূল্য : ১৫০ টাকা

The post সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’: পাঠানুভূতি appeared first on Bangladesh Study Forum.

The Sayings of Confucius

বাংলাদেশের প্রধান সংকট ও বুদ্ধিজীবিদের নীরবতা প্রসঙ্গ

$
0
0

বিবিসিতে প্রকাশিত একটি সংবাদে এই ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসির ছবিটিই প্রধান ফটোতে দিলাম; বিবিসির সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মেলবন্ধন রয়েছে কীনা। অন্যান্য উৎস থেকেও আরও অনেক ছবি দেয়া যাবে। গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে এরকম শতাধিক ছবি ও ঘটনার জন্ম হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে নিয়মিত অসংখ্য খবর ও ছবি প্রকাশিত হয়ে আসছে।

ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড যদি দেখি তাহলে দেখবো-শহীদ মিনারে বাংলাদেশের একদল নাগরিক সমবেত হয়েছেন, তাদের দাবি দাওয়া জানাতে চেয়েছেন। সেখানে তাদের দাড়ানোর সুযোগ তো দেয়া হয়নিই বরং তাদেরকে মেরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। দণ্ডায়মান শহীদ মিনারের সামনে শায়িত এক তরুণ। এ যেন বর্তমান বাংলাদেশেরই এক প্রতিচ্ছবি! ছবিতে হামলারত ক্যাডার ও দাড়িয়ে থাকা ছাত্রদের মধ্যে ফ্রেমে থাকা কুকুরটিকেই সবচেয়ে বেশি মানবিক মনে হচ্ছে। কুকুরটির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে আন্তরিকভাবেই এ ধরণের পাশবিক হামলার প্রতিবাদ করছে!

ছবিটা বাংলাদেশের চলমান সংকটকে প্রতিনিধিত্ব করছে। গত এক সপ্তাহে যে ধরণের ছবি ও ভিডিওচিত্র সৃষ্টি হয়েছে তা কী আক্রান্তের মা-বাবা, ছোট-ভাইবোন, পরিবারের সদস্যরা হজম করতে পারবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তাদের সন্তানকে পাঠানো যেকোন মা-বাবা আতঙ্কিত না হয়ে পারবে? বা বাংলাদেশের কোন সচেতন নাগরিক কী আতঙ্কিত না হয়ে পারবে?

চলমান এ সংকটকে সুতো ধরে আমার আলোচনায় প্রবেশ করি। আলোচনার পূর্বে কয়েকট প্রশ্ন রাখি। এগুলোর উত্তর ধীরে ধীরে কিছুটা দেয়ার চেষ্টা করবো। আপনারাও এখানে যোগ করতে পারেন।

  1. বাংলাদেশের এখনকার মৌলিক সংকট কী?
  2. আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্যাগুলো দ্বারা আক্রান্ত সেগুলো কী কী?
  3. আর ভবিষ্যতে কোন কোন সমস্যার মোকাবিলা করতে হতে পারে?
  4. সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার পথে আমাদের বাঁধাগুলো কী কী? আমরা কীভাবে সেগুলো উত্তরণ ঘটাতে পারি?

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকটের তালিকা করতে হলে প্রথমেই আমি যেটা বলবো সেটা হলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সংকট। মানে একটি রাষ্ট্রের সচলতার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, একইসঙ্গে তাদের মধ্যে সমন্বয় ও প্রয়োজনীয় যে স্বাধীনতা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সায়ত্তশাসনের অভাব সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

আধুনিক রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ ছবি ক্রেডিট: স্টাডি ডট কম

শাসনবিভাগ, বিচারবিভাগ ও আইনসভার মধ্যে সমন্বয় থাকলেও তা নেতিবাচক অর্থে বিরাজমান। তিনটি বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যের উপরই সবল রাষ্ট্রের চিহ্ন বর্তমান। তিনটি বিভাগই যদি সবল, শক্তিশালী, সচল ও স্বনির্ভর হয় তখন রাষ্ট্রের চাকা সচল থাকে।

রাষ্ট্রের এ তিনটি পাল্লার একটি যদি বেশি ভারি হয় তাহলে পাল্লা একদিকে বেশি ঝুলে যাবে এবং অন্য পাল্লা দুটোকে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে। এখানে বেশিরভাগ ক্ষমতা শাসনবিভাগের উপর ন্যাস্ত বা শাসনবিভাগ নিজে সেসব ক্ষমতা বাগিয়ে নিয়েছে। শাসনবিভাগ বিচারবিভাগের উপর প্রভাব রাখে, বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারের ফলাফল নির্ধারণে শাসনবিভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সুস্পষ্ট।

বেশিরভাগ ক্ষমতা শাসনবিভাগের উপর ন্যাস্ত বা শাসনবিভাগ নিজে সেসব ক্ষমতা বাগিয়ে নিয়েছে। শাসনবিভাগ বিচারবিভাগের উপর প্রভাব রাখে, বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারের ফলাফল নির্ধারণে শাসনবিভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সুস্পষ্ট।

স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচারবিভাগ গঠনে বাংলাদেশকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত; দুজায়গাতেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ন্যায়বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত করছে।

জনসংখ্যা ও সংকটবহুল দেশটির শত সহস্র মামলা নিষ্পত্তিতে যে বিচারিক অবকাঠামো নির্মাণ দরকার তা অনেক কম। বিচারক নিয়োগ বাড়লেও বিশাল সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তিতে তা অনেক কম।

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে অপর বিভাগ; আইনসভা শুরু থেকে খুবই দুর্বল। নব্বইয়ের পর তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলেও কখনো মজবুত সংসদ ছিলো না। নব্বইয়ের পর থেকেই সংসদে সরকারদল ও বিরোধীদলের সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ ছিল না। বিরোধীদলকে কোণঠাসা করে রাখা বা কথায় কথায় বিরোধী দলের সংসদ অচল করে রাখা বা সংসদ বয়কটের হুমকি সুন্দর সংসদ উপহার দিতে সহায়তা করেনি। সংসদে সরকারী দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে যে চমৎকার যুক্তর লড়াই হওয়ার কথা তা আমরা খুব কমই দেখিছি। সরকারী দল কর্তৃক সরকার প্রধান বা দলীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের স্তুতি এবং বিরোধী দলের প্রতি বিষোদগার আবার বিরোধী দলের সাংসদ কর্তৃক বিরোধীতার জন্য বিরোধীতার সংস্কৃতি সংসদকে সবল হতে দেয়নি। আমাদের গৌরবজনক সংসদীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। দিনদিন সেটি আরো নাজুক হয়ে একদলীয় মঞ্চ হয়ে দাড়িয়েছে যার অর্ধেক সদস্য আবার বিনা ভোটে নির্বাচিত। তাদের উপর জনগণের ম্যান্ডেট নেই তাই তাদের তেমন দায়বদ্ধতাও নেই। এছাড়া অন্যরাও প্রহসনের ভোটে, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হয়েছেন। সবাই মিলে সংসদকে একটি নাট্যমঞ্চ বানিয়ে রেখেছেন। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা, নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি করা ছাড়া এই সংসদের অর্জন কী তার তালিকা করলে হতাশই হতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদে এমপিগণ তাদের দলনেতা বা শীর্ষনেতাদের স্তুতি গেয়ে যে সময় ও দেশের অর্থ অপচয় করেছেন তার চেয়ে কাজের কথা কয়েকগুণ কম বলেছেন।

স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদে এমপিগণ তাদের দলনেতা বা শীর্ষনেতাদের স্তুতি গেয়ে যে সময় ও দেশের অর্থ অপচয় করেছেন তার চেয়ে কাজের কথা কয়েকগুণ কম বলেছেন। আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদে যেরকম স্তুতি গায় তা উন্নত বিশ্ব দূরের কথা ভারত-পাকিস্তানের সংসদেও হয় না। আমাদের সাংসদদের স্তুতির সঙ্গে কেবল আফ্রিকার কয়েকটি দেশের তুলনা করা যাবে। অথচ সংসদে অধিবেশন চলাকালে রাষ্ট্রের অর্থের যে ক্ষতি হয় তা দিয়ে কোটিখানেক মানুষের কয়েকদিনের খাবারের ব্যবস্তা করা যেতো, কয়েক লাখ যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতো। গুদের উপর বিষফোড়া হলো অনেকটা অকার্যকর এ সংসদ চালাতে যে খরচ হয় তাতে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পার্লামেন্টগুলোর কাতারে নাম লিখিয়েছি। তৃতীয় বিশ্বের এ দেশটিতে, দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশটির সাংসদের কাছে আরও দায়বদ্ধতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা দাবি আমরা করতেই পারি। সংসদকে সচল ও কার্যকর করা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাত্র চল্লিশ বছরের ইতিহাসে তিন থেকে চারটি সরকার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচেনে নির্বাচিত এবং তাদের স্বাভাবিক প্রস্থান ঘটেনি। কীভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে এবং কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এ বিষয়টি এখনো নির্ধারণ হয়নি।

ক্ষমতা হস্তান্তরের সংকট

বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটা বড় সংকট হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সংকট। প্রতিটি সরকারই ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করেছে। মাত্র চল্লিশ বছরের ইতিহাসে তিন থেকে চারটি সরকার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচেনে নির্বাচিত এবং তাদের স্বাভাবিক প্রস্থান ঘটেনি। কীভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে এবং কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এ বিষয়টি এখনো নির্ধারণ হয়নি। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে এ বিষয়টিতে এখনো সুরাহায় পৌছেনি বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন দিনদিন আরো দুর্বল আকার ধারণ করছে। মাঝখানে দুয়েকটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রশংসনীয় ভূমিকা দেখা গেলেও ধীরে ধীরে নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি তার সায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতা হারিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে।

কেন্দ্র দখল করে জালভোট ছবি-যুগান্তর

নির্বাচনে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা এ দেশের মানুষের প্রাণের দাবি। তারা সুষ্ঠুভাবে, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতেই বিভিন্ন সরকার এ ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছে, প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করেছে। মনে রাখতে হবে আমাদের রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে একটি নির্বাচনের ম্যান্ডেট জড়িত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্যান্ডেট না পেতাম তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হতে কীনা তা ভাবার বিষয়।

ভোটের মাধ্যমে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের ভ্রুণ প্রতিষ্ঠা হলো সে স্বাধীন রাষ্ট্রে শুরু থেকেই কেন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের চর্চা চলছে। ইয়াহিয়া খানের মতো একজন ঘৃণিত ব্যক্তির হাতে এতো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারলে স্বাধীন বাংলাদেশে কোন সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও প্রশ্নহীন নির্বাচন হচ্ছে না কেন?

এ প্রশ্নগুলো আমাদের করতে হবে। আমাদের স্বাধীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং বাংলাদেশকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা ও ভোটাধিকার প্রয়োগ করা শিখতে হবে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারবিহীন একটি ভোটকেন্দ্রের দৃশ্য। এরকম হাজারো ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে আসেনি ভোটাররা বা তাদের আসার প্রয়োজন ছিল না। ছবি সূত্র: ডয়েচে ভেলে

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের বাইরেও অন্যান্য যে কয়েকটি সায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, ন্যায়পাল; এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ও ক্ষমতা সুস্পষ্ট নয়। সে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বা তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেনা।

আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা থাকে এবং একটির সঙ্গে অপরটির চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের একটা সম্পর্ক থাকে। কোন বিভাগ যখন অপর কোন বিভাগ বা বিভাগসমূহের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করে তখন রাষ্ট্র কাঠামোর ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

আধুনিক রাষ্ট্রের চতুর্থ পিলার বা স্তম্ভ বলা হয় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে তা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে বুঝতে পারেন। সরকারের সমালোচনা করে বা সরকারের কর্মকাণ্ডকে সমালোচনা খবর প্রচারের জন্য অনেক সংবাদপত্রকে হুমকি দমকি দেয়াসহ অনেকগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৫৭ ধারার মতো একটি ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে যার মাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন হচ্ছে গণমাধ্যমেও এর চর্চা হচ্ছে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা হচ্ছে। নির্মোহ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য যে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দরকার তা পেতে আমাদেরকে অনেক দূর যেতে হবে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সভা সমাবেশের স্বাধীনতা আজ নেই বললেই চলে। সর্বশেষ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন অ্যাক্টিভিস্টরা যেভাবে পুলিশি হেনস্তার শিকার হয়েছেন তা আমাদের রাষ্ট্রের নাজুক অবস্থাকে আরো দুর্বলভাবে তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌছেছে যেখানে সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সভা সমাবেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। ভাবখানা এমন সরকার অনুমোদিত কোন বিষয় ছাড়া কেউ রাজপথে নামতে পারবে না, সরকারের কোন সমালোচনা করতে পারবে না, সভা-সমাবেশ করতে পারবে না।

এসব কিছু ঠেলে যারা রাস্তায় নামবেন তাদেরকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেনস্তার শিকার হতে হবে, তাদের টিয়ার গ্যাস-রাবার বুলেটের মুখোমুখি হতে হবে। এর সঙ্গে রয়েছে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের ক্যাডারদের প্রহরা, নিজ হাতে গ্রহণ করা বিরোধী মতকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব।

এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে অনেক ছাত্র-জনতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি মুখ খুলেছেন, রাস্তায় নেমেছেন, আওয়াজ তুলেছেন-হুমকি-দমকির মুখোমুখি হয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সমর্থিত ক্যাডারদের হয়রানির শিকার হয়েছেন-যা বাংলাদেশের এমন ক্রান্তিকালে আশা জাগানিয়া ঘটনা।

পুলিশি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন ফাহমিদুল হকের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা ছবি সংগ্রহ: অরণ্য আরিফ

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংকটগুলো নিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অনেক বুদ্ধিজীবি জানলেও সেগুলোর দিকে আলো ফেলেন না কেন? রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংকটে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিভিন্ন সংকটে অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবি চুপ থাকেন কেন। সেসব কারণগুলো তল্লাশী করলে আমরা যা দেখবো তা হচ্ছে:

১. ওই বুদ্ধিজীবি চুপ থাকেন কারণ তিনি পুরোদস্তুর বুদ্ধিজীবি হয়ে উঠতে পারেননি বা চেষ্টা করেননি। তিনি বড়জোর চাকুরীজীবি।

২. তিনি অতীতে পরে আছেন। নস্টালজিয়া কিংবা অতীতপ্রেমে মোহাচ্ছন্ন। বর্তমান তাকে ছুঁয়না। বর্তমান সংকট পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে মেলাতে পারেন না। তিনি উটপাখী।

৩. তিনি একজন সুবিধাভোগি। কোন সুবিধাভোগির পক্ষে কথা বলা অসম্ভব।

৪. তিনি জীবন ও পরিবারের ভয়ে আতঙ্কিত।

শেষের পয়েন্টটা নিয়ে যদি আগে কথা বলতে চাই, তাহলে বলা যায় প্রত্যেক মানুষেরই জীবন ও পরিবারের ভয় রয়েছে, বুদ্ধিজীবিরা এর বাহিরে নন। ভীত ও পরিবার নিয়ে সচেতন হওয়া বুদ্ধিজীবিতার একেবারে নেতিবাচক কোন বৈশিষ্ট্য নয়। নিজের জীবন ও পরিবার নিয়ে সতর্ক হয়েও বুদ্ধিজীবি হওয়া যায়।

তবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয়বিশ্বের দেশ ও বহুল সংকটাবর্ত দেশগুলোর জন্য এ বিলাসিতার সুযোগ খুবই কম। এখানে বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অনেক দায় শোধ করতে হয়, অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়।

বুদ্ধিজীবিদের অনেক সমস্যা মাথায় নিয়ে চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করতে হয়। সময়ের সংকট অনুধাবন এবং তা নিরসনে নিজের সুস্পষ্ট অবস্থান নির্ধারণ করা বুদ্ধিজীবির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নোয়াম চোমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিরোধ করে করেই বুদ্ধিজীবি হয়ে উঠেছেন। এডওয়ার্ড সাঈদ মার্কিন মুল্লুকে বসে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েই বুদ্ধিজীবি হয়েছেন। তাদের সামনেও জায়োনিজম বা মোসাদের ভয় ছিল। ভয়-ভীতি উতরে গিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলাটাই বুদ্ধিজীবির কাজ। বাংলাদেশেও অনেক বুদ্ধিজীবি তাদের সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছেন। আনু মোহাম্মদ, সলিমুল্লাহ খান, ফরহাদ মজহার কিংবা রেহনুমা আহমেদরা অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে জিয়া হাসান, ফারুক ওয়াসিফ, কল্লোল মোস্তফাদের মতো বুদ্ধিজীবি ও অ্যাক্টিভিস্টরা নিয়মিত প্রশ্ন উত্থাপন ও বিভিন্ন ইভেন্টে ইন্টারভ্যান করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। তবে এ সংখ্যাটা একেবারেই সংখ্যালঘু। নিজ স্বার্থের বাইরে দাড়িয়ে সবার স্বার্থ নিয়ে, দেশ ও মানুষের স্বার্থ কথা বলা বুদ্ধিজীবি কিংবা মানুষের সংখ্যা খুবই কম।

স্বার্থপরতা ও সুবিধাভোগি আচরণ আমাদের বুদ্ধিজীবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। যার যার স্বার্থের জায়গা থেকে, সুবিধাভোগের জায়গা থেকে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবিরা চুপ থাকেন। জাতির বিবেক হিসেবে স্বীকৃত পাওয়া অনেক বড় বড় বুদ্ধিজীবির নীরবতা খুবই পীড়াদায়ক।

বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় তরুণরা যখন মার খাচ্ছে, রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তখন বেশিরভাগ পক্ককেশী বুদ্ধিজীবিকে মুখ খুলতে দেখা যায় নি। হয়তো তারা আরো পরে বা মোক্ষম সময়ে বয়ান দেবেন।

১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৯০ কিংবা ২০০৭ এও বেশিরভাগ পক্ককেশী বুদ্ধিজীবি বা সরকারী বুদ্ধিজীবিরা ক্ষমতার আশেপাশে থেকেই ক্ষমতার মধু ভোগ করেছেন। বেয়ারা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তরুণরাই ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের যতগুলো বড় পরিবর্তন হয়েছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ছাত্ররা, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট ও চিন্তকরা। সাম্প্রতিক সময়ে সিনিয়র সিটিজেন খ্যাত সরকারের আশেপাশে থাকা বুদ্ধিজীবিদের নীরবতা দেখে তরুণদের শিক্ষা নিতে হবে যে, বড় বড় পক্ককেশীদের উপর নির্ভরশীলতা বা আশাবাদ নয়; তারা আমাদের/আপনাদের বাবা বা দাদা হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতাও রাখে না। বুদ্ধিজীবি নয় স্রেফ বাবা বা দাদার জায়গা থেকে দেখলেই সত্য এসে ধরা পড়তো। তারা অনেকেই চোখ, কান ও মুখ বন্ধ রেখেই চলেন। নিজের স্বার্থের বাইরে বেশি পা ফেলেন না, মুখ খুলেন না, সরকারকে নারাজ করেন না। সরকারকে তোয়াজ করে চললেই তাদের লাভ তাই আপনার বা আমাদের লাভ দেখার তাদের টাইম নেই।

আমাদের প্রজন্মের তরুণদের নিয়ে বলা হয়; তারা রাজনীতি বুঝে না, উচ্ছন্নে যাওয়া প্রজন্ম, ফেসবুক প্রজন্ম কিন্তু এরাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও যে দম, জজবা দেখাচ্ছে এটাই তাদেরকে সবল করবে, ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য তৈরি করবে। গুন্ডাদের ক্ষমতা বা গুন্ডাদের প্রভাব বড়জোর পাঁচ বছর বা এক দশক। ছাত্রজনতার প্রতিরোধী প্রজন্মটির নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার খাতায় লেখা থাকবে।

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মার খেয়ে যাওয়া সেইসব সাহসী তরুণদের হাতেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত। তারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেলে জয় একদিন আসবেই। যে ত্যাগ, রক্ত, ঘাম ঝড়েছে তা ব্যর্থ হওয়ার জন্য নয়।

অনেকে বলেন একদল চাকুরপ্রার্থীর বৈষম্যে রাষ্ট্রের কী যায় আসে? তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতার কী রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে? মনে রাখতে রাষ্ট্রের অনেক ছোট ছোট বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেই বড় বড় বিষয়গুলোর সুরাহা হয়। আপাতদৃষ্টিতে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির চাকুরীতে বৈষম্যহীন সুযোগের দাবি মনে হলেও তা আরো অনেক বড় বড় প্রশ্নের কাছে নিয়ে যায়।

সমান্য কাগজের দামের পার্থক্য, লবণের দামের ফারাক ও চাকুরীতে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল যা পরবর্তীতে বড় বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে এবং তার মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল। রাষ্ট্রভাষার মতো আপাত নিরীহ একটা ইস্যুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করে দিয়েছিল। কোন ইস্যুই ছোট নয়; যেখানে ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ঐকমত্য রয়েছে সেটিতো ছোট হতেই পারে না!

সমান্য কাগজের দামের পার্থক্য, লবণের দামের ফারাক ও চাকুরীতে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল যা পরবর্তীতে বড় বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে এবং তার মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে, স্বাধীন বাংলাদেশে যেকোন বৈষম্যমূলক আইন, রীতি-নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলা বর্তমানের বুদ্ধিজীবিদের অন্যতম দায়িত্ব। ছাত্ররা একটি জাতির এন্টেনা-রাষ্ট্রের গভীর সংকট তাদের অ্যান্টেনায় প্রথম ধরা পড়ে, প্রথম সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করে এই অংশটিই। তাই তাদের পাশে আত্মিক ও মানসিকভাবে থাকা যেকোন বুদ্ধিজীবি কিংবা সচেতন মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

The post বাংলাদেশের প্রধান সংকট ও বুদ্ধিজীবিদের নীরবতা প্রসঙ্গ appeared first on Bangladesh Study Forum.

দ্য লেইট হিরোস অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কাপ

$
0
0
  • এই প্রতিযোগিতায় টুর্নামেন্টের শেষের দিকে খেলোয়াড়দের জেগে ওঠার একটি ইতিহাস রয়েছে।
  • তাদের কেউ কেউ টুর্নামেন্টের নায়ক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
  • ঠিক ২০১৮ সালেও এরকম ভূমিকা পালন করার মতো খেলোয়াড় সেমিফাইনালে উঠে যাওয়া দলগুলোর মধ্যে রয়েছে।

ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলোয়াড়দের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যারা প্রথম রাউন্ডে খুব অল্প প্রবাহ তৈরি করেছিল কিন্তু তারপরেও তারা নায়ক বনে গিয়েছিল প্রতিযোগিতা শেষেরদিকে পৌঁছ গেলে। যেহেতু এবছর বিশ্বকাপ শেষ চারে পৌঁছে গিয়েছে, তাই আমরা বিগত বিশ্বকাপ পর্যন্ত দেরিতে নায়ক বনে যাওয়াদের দেখব এবং কিছু নামের দিকে তাকাবো যেগুলো ২০১৮ সালের রাশিয়া  বিশ্বকাপ থেকে তালিকাভুক্ত হতে পারে।

১৯৫৮– পেলে

সুইডেনের ১৯৫৮ সালের টুর্নামেন্টটি প্রায়ই পেলের বিশ্বকাপ হিসেবে মনে করা হয়, কিন্তু খুব কম লোকই এখন জানে যে তিনি প্রথম দুই ম্যাচে অংশই নেননি। একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সময় ইনজুরি ১৭ বছর বয়সী পেলেকে প্রথম দুটি ম্যাচ থেকে দূরে সড়ে দেয় এবং তার পরিবর্তে ফিউচার ইতালিয়ান স্ট্রাইকার  জোসে আলতাফিনি, যিনি সেলেসাওদের হয়ে সামনে থেকে শুরু করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গ্রুপের চূড়ান্ত ম্যাচ খেলার জন্য পেলেকে পুনরায় দলে অন্তভুক্ত করা হয়, কিন্তু তিনি সে  ম্যাচে তিনি সামান্য প্রভাব ফেলেন।

নক আউট পর্বে  কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম গোলের দেখা পান পেলে ৭৩ তম মিনিটে। সেটি ছিল সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য প্রতিভাবান কিশোর পেলে যার থেকে হ্যাটট্রিকের কারণে সেমিফাইনালে ব্রাজিল ৫-২ গোলের  ব্যবধানে  ফ্রান্সকে পরাজিত করে এবং স্বাগতিক দেশ সুইডেনের  বিপক্ষে ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হয়। এই ম্যাচে তার দুটি গোল এবং শেষ মিনিটে একটি অসাধারণ হেডের মাধ্যমে গোল  করে তিনি একটি নতুন ফুটবল সুপারস্টারের আগমনের বার্তা দেন।

১৯৬৬– স্যার জিওফ হার্স্ট

ইংলিশ তরকা হার্সট

ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডের স্ট্রাইকার জিউফ হার্স্ট, পরে নাইট উপাধি পেয়েছিলেন, যিনি ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড দলের হোম গ্রাউন্ডে বিশ্ব কাপ জয়লাভ করার জন্য ‘অনুমিত’ ছিলেন না। এটি ছিল টটেনহাম হটসপের নায়ক জিমি গ্রিভস  কিন্তু গ্রিভস প্রথম রাউন্ডের খেলায় নেট খুজে পেতে ব্যর্থ হয় এবং ইনজুরি তাকে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে দেয়। সে ম্যাচে গ্রিভসের পরিবর্তে নেমে হার্স্টের বুদ্ধিমান হেডে করা গোলটি ছিল সে ম্যাচের একমাত্র গোল।

হার্স্ট সেমিফাইনালের জন্যও দলে ছিলেন এবং ইংল্যান্ড কোচ স্যার আলফ রামসি গ্রীভসের ফিটনেসে ফিরে আসার পরও ফাইনালের জন্য একই দল বেছে নেওয়ার  মতো কঠিন সিদ্ধান্তটি নেন। এটি একটি অনুপ্রাণিত সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়,  হার্স্টের বিখ্যাত হ্যাটট্রিকে ইংল্যান্ড  তাদের একমাত্র বিশ্ব কাপ জয় করে।

১৯৮২ – পাওলো রসি

ইতালীর তারকা রসি

সম্ভবত সবচেয়ে আশ্চর্য এবং অপ্রত্যাশিত ‘ লেইট হিরো’ ছিলেন ইতালিয়ান পেনাল্টি বক্স শিকারী পাওলো রসি। ইতালির ১৯৭৮ বিশ্বকাপের দলের তারকাদের মধ্যে রসিও ছিলেন একজন , কিন্তু ১৯৮২ সালে তিনি সবে বেটিং স্কান্ডালের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে পেশাদার খেলোয়াড়ি জীবনে ফিরে এসেছেন। দুর্ভাগজনকভাবে তিনি উদ্বোধনী রাউন্ডের খেলায় ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন এজন্য সংবাদত্রগুলি তার খেলা হারিয়ে গেছে বলে তাকে ধুয়ে দিতেছিল।

যখন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে  ইতালি ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়েছিল তখন  ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক ওয়ালডির প্যারেস তাঁর খেলার প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে আগেই বলেছিলেন যে, রসি আবার তার খেলা  ফিরে পেতে পারেন। সেটা প্রমাণিত হয় রসির হ্যাট্রিকের মাধ্যমেই যেখানে ইতালি  3-2 ব্যবধানে  জয়ী হয় যা ইতালির বিশ্বকাপের সবচেয়ে স্মরণীয় এক ম্যাচ। রসিই সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ফাইনালে ওয়েস্ট জার্মানির বিপক্ষে  আরও এক গোল করে দলকে জিতিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলের মালিক হয় এবং স্টার বনে যান।

২০০৬ – ফেবিও গ্রোসো

২৪ বছর পর আরেকটি ইতালীয় দল ট্রফি তুলে নেয় এবং এই দলের প্রখ্যাত খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিল গিয়ানিলিগি বুফন, ফেবিও কানাভারো, আন্দ্রে পিরলো, ফ্রান্সেসকো টোটি  অন্যদিকে ফেবিও গ্রোসো পলরোমো ক্লাব থেকে লেফট ব্যাক হিসেবে এসেছিল যা একজন বহিরাগত এর মতো ছিল। ইতালি এর প্রথম রাউন্ড খেলা শুরু হলে প্রথম দুই ম্যাচে সেরকম ছাপ রাখতে পারেনি যার ফলে তার নাম সেভাবে উচ্চারিত হয়নি।

১৬ রাউন্ডের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে  তারা ১০ জনের দলে পরিণত হয়ে বিপদে পরে গিয়েছিল , যখন গ্রসো একটি গুরুত্বপূর্ণ পেনাল্টি আদায় করে নিয়েছিল যা টটি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছিল। গ্রোসোর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল সাথে দলে ছিলেন এবং সেমিফাইনালে হোস্ট জার্মানির বিপক্ষে দারুণ গোল করে দলকে ফাইনালে তোলেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময়ে ফাইনালে ১-১ ব্যবধানে ড্র করার পর  ম্যাচ পেনাল্টিতে গিয়েছিল এবং শট-আউটে তাদের পাঁচটি কিকই প্রতিপক্ষের জালে পাঠিয়ে ইতালি চতুর্থ বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল। এবং ইতালিয়ানদের হয়ে উদযাপন করার জন্য পঞ্চম পেনাল্টি কে করেছিল? ফেবিও গ্রোসো ছাড়া অন্য কেউ নন।

২০১৮ – ???

সুতরাং, ২০১৮ রাশিয়ায় অতীতের এই মহান ব্যক্তিদের সাথে কে যোগ দিতে পারে? এখানে এমন কিছু  খেলোয়াড়  আছে যারা সেমিফাইনালে আছে

কেভিন ডি ব্রুইন (বেলজিয়াম)

Image result for kevin de bruyne

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে, ম্যানচেস্টার সিটির  শুরুর দিকে সময় কিছুটা  নিস্প্রভ ছিলেন। কিন্তু ব্রাজিলের বিপক্ষে ড্রিস্ট মার্টেনের অনুপস্থিতিতে ডি ব্রুইন একটি গুরুত্বপূর্ণ গোল  করেন এবং নিজেকে বেলজিয়ামের আক্রমণ ভাগ ও পাল্টা আক্রমণের সমস্ত কাজে জড়ান। এটা কি প্রতিপক্ষের লাইন ধ্বংসের জন্য  একটি ঝড়ের শুরু?

রাফেল ভারানে (ফ্রান্স)

Image result for varane france

রিয়াল মাদ্রিদের সেন্টার ব্যাককে নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু উরুগুয়ের বিপক্ষে একটি চমৎকার হেডে গোল করা ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্লিয়ার করা পর্বাভাস দেই যে ফ্রান্সের স্টার ডিফেন্ডার তার সেরা ফর্মে ফেরার  ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।

হ্যারি মাগুইরে (ইংল্যান্ড)

 

লিচেস্টার সিটি ডিফেন্ডার কি ইংল্যান্ডের ফ্যাবিও গ্রোসো হয়ে যাবে? আরেকজন খেলোয়াড় যিনি  পেশাদার খেলার শীর্ষেউঠতে পেরেছে, সুইডেনের বিপক্ষে কোয়াটার ফাইনালে মুখোমুখি হয়ে ইংল্যান্ডকে একটি শক্তিশালী হেডের মাধমে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ ভুমিকা পালন করেন ম্যাচে ।

এন্দ্রেজ ক্র্যামারিক (ক্রোয়েশিয়া)

Related image

ভাট্রেনি ভক্তরা হফেনহাম ফরোয়ার্ডের থেকে আরও বেশি আশা করছিল,  ক্রোয়েশিয়া একাদশের বাহিরে ছিলেন  যখন তারা  নাইজেরিয়ার বিপক্ষে তাদের প্রথম ম্যাচ খেলা শুরু করে। কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়াকে তার হেডে  দ্রুত গোল পরিশোধ  করে  আর কোচ জালাত্কো ডালিক চাইবে ক্রমিকে শুরু থেকেই খেলানো এরকম আরো গোল করার জন্য।

The post দ্য লেইট হিরোস অব দ্যা ওয়ার্ল্ড কাপ appeared first on Bangladesh Study Forum.

বিশ্ব নেতা হওয়ার পথে চীন

$
0
0

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে এক টেবিলে বসিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে যতটা না দুইদেশের কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব চীনের এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের। এশিয়ার উদীয়মান অপর পরাশক্তি ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোন আকর্ষনে চলে গেলেন চীনে? নতুন নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনে কোন দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে? মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয়ের কোন দেশটি নতুন বলয়ে নের্তৃত্ব দিচ্ছে-উত্তর হবে চীন। নিজের অর্থনৈতিক ক্ষমতা শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে এখন রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ চীনের।

বৈশ্বিক অর্থনীতি সংস্কার বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার পাশপাশি বিশ্বে প্রভাবশালী উপস্থিতি জানান দিতে চাচ্ছে চীন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত জুনে জানিয়েছিল চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কূটনীতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) জাতিসংঘে (ইউএন) নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে চাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি

বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপল সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং ছবি: গেটি ইমেজেস

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে আরব বিশ্বে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে সংকটপূর্ণ অঞ্চলটিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার দিকে আগাচ্ছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পে আরব দেশগুলোকে হাজার কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে

গত মঙ্গলবার বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপল সম্মেলন কেন্দ্রে চীনআরব সহায়তা ফোরামের অষ্টম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় ওই আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিস্তারিত না জানিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় থাকা আরব দেশগুলোতে ইতিবাচক সামাজিক প্রভাব রাখতে ওই ঋণ দেয়া হবে

সম্মেলনে শি আরো জানান, ‘অর্থনৈতিক পুনর্গঠন শিল্প খাত পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে গৃহীত চীনের একটি বিশেষ কর্মসূচির অংশ এটি

এছাড়া আরব অঞ্চলেরস্থিতিশীলতা রক্ষায় সক্ষমতা বাড়াতে বেইজিং আরো ১০০ কোটি ইউয়ান সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন শি সাধারণত পুলিশি কাজ নজরদারির ক্ষেত্রে পরিভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে

চীনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন শি এরই মধ্যে আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্র জিবুতিতে প্রথম সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে চীন

এছাড়া চীন এরই মধ্যে আরব দেশগুলোয় প্রচুর পরিমাণ অর্থ সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চায়না আফ্রিকা রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রাক্কলিত হিসেবে শুধু জিবুতিকেই ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন

বার্তা সংস্থা এএফপির খবর অনুসারে চীনের এমন আর্থিক বদন্যতার বিষয়টি বিভিন্ন দেশের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ বিশাল ঋণের ভারে গরিব দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে গত বছর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দরের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে হস্তান্তর করেছে শ্রীলংকা

শি জিনপিংয়ের ভিশনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছেবেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাচীন সিল্করুটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছেন শি এককালে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের বস্ত্র, মশলা অন্যান্য পণ্য আমদানিরফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল সিল্করুট

ঐতিহাসিক রুটটির কেন্দ্রে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যকে চীনেরস্বাভাবিক অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে শি আরো বলেন, তিনি আশা করছেন পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে ঐকমত্যের মাধ্যমে সম্মেলনটি শেষ হবে

সিল্করুটের ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রসঙ্গ টেনে শি বলেন, ‘দূরত্বের দিক থেকে চীন আরবরা অনেক দূরের হলেও তারা পরিবারের মতোই কাছের

চীনের সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দর, সড়কপথ রেলপথ স্থাপন করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি অনেকের আগ্রহ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটাকে অনেকে চীনা সম্প্রসারণবাদের বিস্তার হিসেবে দেখছেন

চীনা প্রেসিডেন্ট শি অবশ্য বাণিজ্যের দিকটিতেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আরব দেশগুলোয় বন্দর রেলওয়ে নেটওয়ার্ক স্থাপনে অংশগ্রহণের সুযোগকে স্বাগত জানাচ্ছে চীন এর মাধ্যমেমধ্য এশিয়ার সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকার সংযোগ, ভারত মহাসাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ স্থাপিত হবে

২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছেন শি জিনপিং প্রতিষ্ঠা করেছেন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মতো চীনের প্রভাবাধীন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান এছাড়া ঐতিহাসিক বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন সিল্ক রোড শুরু করেছেন

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছে বেইজিং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা, ইরান চুক্তিকে ছুড়ে ফেলা এবং ব্রেক্সিট অন্যান্য বিষয়ে ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে টানাপোড়েনের ফলে আস্থার জায়গা নেয়ার চেষ্টা করছে চীন

এ বিষয়ে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি সুন্দর প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড। সেখানে চীনের বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যত উচ্চাকাঙ্খা (অ্যামবিশন) তুলে ধরেছেন রুড। আর্টিকেলটির লিংক: https://www.project-syndicate.org/commentary/xi-jinping-has-a-coherent-global-vision-by-kevin-rudd-2018-07

গত জুনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের নিয়ে দুদিনব্যাপী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে শি বলেন, চীনকে অবশ্যই নিজেদের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করতে হবে এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের পথ দেখাতে হবে এবং তা পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে

চীনা প্রেসিডেন্টের বরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এর মাধ্যমে একটি আধুনিক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক চীন গঠনের শর্ত তৈরি হবে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, দুদিন ব্যাপী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্র বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি, সেনাবাহিনী, প্রোপাগান্ডা বিভাগ চীনের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কর্মকর্তারা

প্রস্তাবিত নতুন ধারার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সব পক্ষের জন্য উইনউইন পরিস্থিতি সবার পারস্পরিক লাভের কথা বলা হয় তবে দক্ষিন চীন সাগরে চীনের বিতর্কিত অবস্থানকে উন্নত বিশ্ব সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছে

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুতের আকাঙ্খার কথা জানান শি যাদেরকে তিনি স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে বর্ণনা করেন একই সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকেও শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন 

চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেছেন শি জিনপিং ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ, উত্তর কোরিয়া নিয়ে সরাসরি কোন মন্তব্য করেননি চীনা প্রেসিডেন্ট এছাড়া শি স্বশাসিত তাইওয়ান নিয়েও মন্তব্য করেননি যাকে চীনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ভৌগলিক কূটনৈতিক ইস্যু মনে করা হয়

এদিকে সিএনএন মানির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে অস্বস্তিকর সময়ে এসে পড়েছে চীন সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেখা গেছে চীনের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কার চেয়েও দ্রুতগতিতে দুর্বল হচ্ছে দেশটির দুর্বল প্রবৃদ্ধি তার বড় বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য মারাত্মক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসবে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করা বৈশ্বিক কোম্পানীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে

এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র বিরোধ সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে গত সপ্তাহে উভয় পক্ষই একে অন্যের পাঁচ হাজার ডলার মূল্যের পণ্যে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংকট আরেক ধাপ বাড়িয়ে গেলো সোমবার বিশ হাজার কোটি মূল্যের চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন

গত সপ্তাহে একটি রিসার্চ নোটে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের চীফ এশিয়া ইকোনমিস্ট মার্ক উইলিয়ামস বলেন, বাণিজ্য উত্তেজনা ঠিক সময়টাতে তীব্রতর হচ্ছে যখন দেশীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে

সরকারী উপাত্ত অনুসারে গত বছরে চীনের অর্থনীতি বেশ ভালোই কাজ করেছে এবং ছয় দশমিক ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে চলতি বছরেরও শুরুতেও সে গতি অব্যাহত ছিল কিন্তু বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন গতি থাকবে কী না নিম্নমুখী গতির নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে

গত মাসের সরকারী উপাত্তে দেখা যায় রফতানি, বিভিন্ন কোম্পানীর বিনিয়োগ এবং ভোক্তাব্যয় গত বছরের একই মাসের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে

গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এশিয় অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান লুই কুইজিস বলেন, উপাত্তগুলো দেখে বিস্তৃত মন্দা পরিস্থিতি সৃষ্টির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবং আমরা আশা করছি এটি অব্যাহত থাকবে।’

উচ্চশিক্ষার জন্য চীন এখন মেধাবী শিক্ষার্থী ও গবেষকদের আকর্ষনের কেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে। কোন একটি দেশকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে জায়গা পেতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর উদাহরণ স্থাপন করতে হয়। চীন ধীরে ধীরে এদিকে পা বাড়াচ্ছে। এছাড়া আধুনিক সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে চীন তার দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ পরিস্থিতি চীন কীভাবে মোকাবেলা করবে এবং এর সমাপ্তি কীভাবে ঘটায় বা বাণিজ্য যুদ্ধ পরিস্থিতি সামলে নিজেদের অবস্থান কীভাবে ঠিক রাখে তার উপর নির্ভর করছে চীনের বিশ্ব নেতা হয়ে উঠার বিষয়টি।

The post বিশ্ব নেতা হওয়ার পথে চীন appeared first on Bangladesh Study Forum.

Viewing all 635 articles
Browse latest View live