ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কারকে পুঁজি করে,ধর্মের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজে কালের গতিতে যে কিছু অসাধু লোক (ধর্মব্যবসায়ী) উদ্ভব ঘটে তারই প্রতিচ্ছবি “লালসালু”। লেখক “লাল সালু” উপন্যাসে মানুষের সীমাহীন দুঃখ,বৈকল্য,কপটতা ও মিথ্যাকে উন্মোচন করেছেন এবং জীবনের প্রত্যয় ও শিল্পবোধের নতুন রুপ ফুটিয়ে তুলেছেন। ভাগ্যান্বেষী মজিদের জীবনের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্তি ও সংগ্রামের কাহিনী নির্মাণ করতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পূর্ববাংলার গ্রামীণ সমাজের বাস্তবসম্মত ও শৈল্পিক চিত্র অঙ্কন করেছেন।
এ উপন্যাসে তিনি এমন এক গ্রামীণ সমাজের চিত্র এঁকেছেন যেখানে পূর্ববাংলার কৃষিভিত্তিক শ্রমনিষ্ঠ, সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমাজের মানুষ বিভ্রান্ত হয় এক কপট ধর্ম ব্যবসায়ী দ্বারা।একটি কৃষিপ্রধান গ্রামীণ সমাজে মজিদ তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য খুব সহজেই ধর্মের বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। কারণ সেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি।’
গভীর জীবন সমস্যায় জর্জরিত মজিদ জীবিকা অর্জনের মৌলিক প্রয়োজন থেকেই ধর্ম ব্যবসার পথ বেছে নেয়। আমরা দেখি মহব্বত নগর গ্রামের মজিদের প্রবেশ ঘটে নাটকীয়ভাবে। তাহের ও কাদের যখন মাছ ধরছিল তখন তারা মজিদকে দেখতে পায় মতিগঞ্জের সড়কের ওপর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে মোনাজাতরত অবস্থায়। এরপর গ্রামে ঢুকে অজানা এক ভাঙা কবরকে মোদাচ্ছের পীরের কবর হিসেবে চিহ্নিত করে এবং স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেখানে এসেছে এ মিথ্যা কুহক বিস্তার করে গ্রামের মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে সম্পদ ও ঐশ্বর্য শিকারে লিপ্ত হয়। মজিদ এবং তার শিকার ধর্ম বিশ্বাসে অনড় এ সহজ-সরল গ্রামীণ মানুষ। যে সমাজে নানারকম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, সেখানে মিথ্যাকে সুকৌশলে দ্রুত বিস্তার ঘটানো সম্ভব করে তোলে মজিদ।
আধুনিক ছোয়ায় উজ্জীবিত আক্কাস মিয়ার স্কুল করার প্রয়াসকে সুকৌশলে মসজিদ নির্মানের কথায় ব্যর্থ করা, বাপ-বেটাকে ক্ষমতার দাপটে প্রকাশ্যে বাজারে কয়েক মিনিটের মধ্যে খতনা করা এবং দুদু মিয়াকে ধমক দিয়ে বলে “কলমা জানো মিয়া” এ রকম কার্যলাপের মাধ্যমে নিজের প্রতিপত্তিকে আরো শক্ত করে।
ধর্মকে পুজি এবং লালসালুতে আবৃত অজানা মোদাচ্ছেরের মাজারকে কেন্দ্র করে মজিদের পুজিবাদের কারখানা গড়ে ওঠে।যে কারখানায় সাধারণ মানুষের সরলতা ও নিরক্ষরতা ছিল কাচামালের মতো। পূর্ববাংলার গ্রামীন সাধারণ মানুষের ধর্মভীতি বেশী থাকায় সহজে প্রলোভন খাটিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলে। গারো পাহাড় থেকে চলে আসা মজিদের নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও কামতৃঞা মিটানোর জন্য সময় এবং পরিবেশের সাথে নিজেকে নতুন মোড়কে বদলিয়ে ফেলে। ধর্মের প্রতি নিজে নিষ্ঠ না হয়ে গ্রামবাসীর মনে কৌশলে ধর্মভাব জাগিয়ে তাদের শাসন ও শোষণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মজিদ চরিত্রে উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।
মজিদ তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে অর্থনৈতিক মেরুদন্ডকে সোজা করার জন্য ধর্মের ছদ্মাবরণে প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একদিন গারো পাহাড় থেকে মহব্বত নগর গ্রামে এসেছিল। তার উদ্দেশ্যও সফল হয়েছিল অর্থ-প্রতিপত্তি, ক্ষমতার দাপট এং নারী শরীর সবই পেয়েছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে একদিন নড়বড়ে অস্তিত্ব নিয়ে ফসলের ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে সে হাঁটছে। এটাই হয়তো সময়ের স্বার্থবাদীতা ? মজিদ জানে না তার এ হাঁটার শেষ কোথায়? পিছনে রেখে যায় জমিলা,রহিমা,খালেক ব্যাপারী ও গ্রামের নিরীহ মানুষ। পরিশেষে দেখতে পারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু ফসলেরই ক্ষতি হয়নি সেই সঙ্গে মজিদের মনস্তাত্বিক পরিবর্তনও হয়েছিল এবং যোগ হয়েছিল নতুনমাত্রা
প্রতারণাটুকু বাদ দিলে পুজিহীন ব্যবসার অন্যতম ব্যবসা হল ধর্ম ব্যবসা। হবেই বা না কেন, লাল সালুতে আবৃত শুধু নিরব মাজারটিই ঢাকা নয়, তার সঙ্গে ঢাকা আমাদের আমাদের বুদ্ধিমত্তাটুকু। ক’জন যাই নি অসুখ-বিসুখে ডাব পড়া পানি নিতে ও সাদা/লাল ফিতা আনতে। ক’টা লোক মানত করিনি মোমবাতি,টাকা-পয়সা ও লাল কাপড়ে দৃষ্টি নিবদ্ব করে। এখন চিন্তা করে দেখুন আসলে অসুখটা কার? লাল সালুর?
না,আমি বলব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির,আমাদের বিশ্বাসের,আমাদের সচেতনতার।
আজও কিন্তু আমাদের এই দেশ এই ব্যবসা থেকে মুক্তি পায়নি বরং এই রোগ আমাদের আরো চেপে ধরেছে। আর ঠিক সেই দিক থেকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর “লাল সালু” এক অসাধারণ লেখা।
লেখক : ওয়ালী উল্লাহ
The post বুক রিভিউ : লালসালু appeared first on Bangladesh Study Forum.